Tuesday, November 26, 2024
spot_img
Homeজাতীয়বাংলাদেশের নির্বাচন আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক মানদণ্ড পূরণে ব্যর্থ

বাংলাদেশের নির্বাচন আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক মানদণ্ড পূরণে ব্যর্থ

আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক মানদণ্ড পূরণে ব্যর্থ হয়েছে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। আক্ষরিক অর্থে, রাজনীতির মাঠে ছিল না কোনো প্রতিযোগিতা। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। গণগ্রেপ্তারের কারণে বিরোধীরা ব্যস্ত ছিল আদালতপাড়ায়। ফলে ছিল না আন্দোলন-সংগ্রামের স্বাধীনতা। রাজনৈতিক দলগুলোর আসন ভাগাভাগি চুক্তি এবং আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ও দলের সঙ্গে যুক্ত স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে ভোট হওয়ায় ভোটারদের পছন্দের প্রার্থীকে বেছে নেওয়ার সুযোগ ছিল না। গত ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন নিয়ে এমন তথ্যই ওঠে এসেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মূল্যায়নে। ইউরোপীয় কমিশনের ওয়েবসাইটে ৩৩ পৃষ্ঠার পূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।

গত জুলাই মাসে সার্বিক পরিবেশ নিয়ে ইইউ প্রাক-নির্বাচনী মিশন বাংলাদেশ সফরে প্রায় শতাধিক বৈঠক করে। বৈঠকগুলো থেকে ইইউ সিদ্ধান্ত নেয়, বাংলাদেশের নির্বাচনে কোনো পর্যবেক্ষক পাঠাবে না। তবে নির্বাচন নিয়ে চার সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ দল বাংলাদেশে পাঠায় সংস্থাটি। নির্বাচনের আগে ও পরে এ বিশেষজ্ঞ দলটি বিভিন্ন বৈঠক ও পরিবেশ-পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচন কিছু গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মানদণ্ড পূরণ করতে পারেনি। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার যার মধ্যে সমাবেশ, সমিতি, আন্দোলন এবং বক্তৃতা অন্তর্ভুক্ত–এগুলো প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য হলেও বাংলাদেশের নির্বাচনের ক্ষেত্রে তা সীমাবদ্ধ ছিল। বিচারিক কার্যক্রম এবং গণগ্রেপ্তারের মাধ্যমে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা মারাত্মকভাবে সীমিত হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক দলগুলোর আসন ভাগাভাগি চুক্তি এবং আওয়ামী লীগের নিজস্ব প্রার্থী ও দলের সঙ্গে যুক্ত ‘স্বতন্ত্র প্রার্থীদের’ মধ্যে প্রতিযোগিতা ভোটারদের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়নি। গণমাধ্যম এবং সুশীল সমাজও বাক্‌স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সহায়ক ছিল না। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের সমালোচনামূলক বিতর্কও ছিল সীমিত।
ভোট শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভোট গণনা শুরু হয়। নির্বাচন কমিশন (ইসি) প্রাথমিকভাবে বলেছিল, ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে। ভোটের দিন ঘোষিত ভোটের হারের তুলনায় শেষ দুই ঘণ্টায় ভোটারের উপস্থিতি সামান্য বেড়েছে। স্বচ্ছতা ও শক্তিশালী নিরপেক্ষ নাগরিক সমাজের অভাব, সব দলের এজেন্ট না থাকায় ইসি ছাড়া ভোটের তথ্য যাচাইয়ের অন্য কোনো সুযোগ ছিল না।

সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আসতে চেয়েছিল। ফলে নির্বাচন একটি অত্যন্ত মেরূকৃত রাজনৈতিক পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও তার জোট শরিকরা নির্বাচন বয়কট করায় প্রকৃত প্রতিযোগিতার অভাব ছিল। বিরোধীরা সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচন পরিচালনায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জানিয়েছিল, যা প্রত্যাখ্যান করা হয়।

প্রাক-নির্বাচনকালীন বিরোধী দলের ধারাবাহিক বিক্ষোভের অংশ হিসেবে ব্যাপক সহিংসতা ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবরের পর গুরুতর রূপ নেয়। পরবর্তী সময়ে বিএনপি নেতাদের গণগ্রেপ্তার ও আটকের ফলে দেশের নাগরিক ও রাজনৈতিক পরিবেশের উল্লেখযোগ্য অবনতি ঘটে। নির্বাচনের পুরো সময়ে বিরোধী দলগুলোর সমাবেশ, সমিতি, আন্দোলন এবং বক্তৃতার স্বাধীনতা কঠোরভাবে সীমিত করা হয়। গ্রেপ্তার এড়িয়ে যে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষমতা বিএনপির পক্ষে অসম্ভব ছিল। কারণ প্রায় সব জ্যেষ্ঠ নেতৃত্বকে কারাবন্দি করা হয়। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ঠেকাতে ফৌজদারি অভিযোগ গঠন ব্যাপকভাবে একটি কৌশলের অংশ হিসেবে ব্যবহার হয়েছে বলে মনে করে সংস্থাটি। বিশ্বাসযোগ্য গণতান্ত্রিক আচরণের জন্য মৌলিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার অপরিহার্য, যা বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক চুক্তিতে বলা আছে। কিন্তু এই অধিকারগুলো ক্ষুণ্ন করা হয় আইন দ্বারা, যা অযথা বাক-স্বাধীনতার অধিকারকে সীমাবদ্ধ করে।

নির্বাচনে প্রকৃত প্রতিযোগিতার অভাব দেখেছে ইইউ। ২৯৯ আসনের বিপরীতে ১ হাজার ৯৭০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও ৭৪ শতাংশ প্রার্থী ন্যূনতম ভোট না পাওয়ায় জামানত হারিয়েছেন। আর মাত্র ১১ শতাংশ আসনে প্রতিযোগিতা দেখা গেছে। নির্বাচনে কোনো স্বাধীন আন্তর্জাতিক নির্বাচনী পর্যবেক্ষক পর্যবেক্ষণে আসেনি। কমনওয়েলথ এবং যুক্তরাষ্ট্রের আইআরআই ও এনডিআই একটি যৌথ মিশন ছোট বিশেষজ্ঞ দল পাঠিয়েছে। তবে ইসি সব খরচ দিয়ে কিছু একক বিদেশি পর্যবেক্ষককে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, যা নির্বাচনী পর্যবেক্ষণের আন্তর্জাতিক যে নীতিমালা রয়েছে, তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।

নির্বাচনী প্রচারের সময়কাল অতিমাত্রায় নির্দেশমূলক আইনি বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। আওয়ামী লীগই ছিল একমাত্র রাজনৈতিক দল, যে বৃহৎ প্রচার মিছিলসহ যে কোনো উল্লেখযোগ্য জনসাধারণের কার্যক্রম সংগঠিত করতে পেরেছে। নির্বাচনে প্রচারণার সময় ভোটারদের ভয়ভীতি দেখিয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনতে সামাজিক সুরক্ষাগুলো বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। এ ছাড়া ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনতে পরিবহন ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল, যাতে ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভিড় দেখানো যায়। ভোটকেন্দ্রের বাইরে আওয়ামী লীগের কর্মীদের উপস্থিতির কারণে ভোটারদের জন্য পরিবেশ ছিল ভয়ের। যদিও সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। এবারের সংসদে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা আগের চেয়ে কমেছে। আগের সংসদে এ সংখ্যা ১৮ থাকলেও, এবার ১৪-তে নেমেছে।

বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের ব্যবস্থা যোগ্যতাভিত্তিক ও স্বাধীন নিয়োগের মাধ্যমে হওয়া উচিত, যা জনস্বার্থে কাজ করার লক্ষ্যে কমিশনের হাত শক্তিশালী করবে। সর্বোত্তম অনুশীলনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ একটি স্বাধীন প্যানেল বিষয়টি তত্ত্বাবধান করতে পারে।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সাইবার নিরাপত্তা আইনকে বাধা হিসেবে দেখেছে ইইউ। পূর্ববর্তী আইন থেকে কিছু উন্নতি সত্ত্বেও এটি আন্তর্জাতিক মানের হয়নি। অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং অস্পষ্ট বিধানগুলো অযৌক্তিকভাবে অনলাইনে মত প্রকাশকে সীমাবদ্ধ করে। তাই বাক-স্বাধীনতার আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের বিধান মেনে সাইবার নিরাপত্তা আইনের বিধানগুলোর পর্যালোচনা করতে হবে। অস্পষ্ট এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিধিনিষেধগুলোকে সংশোধন করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

RELATED ARTICLES

Leave a reply

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments