মাহে রমজান রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস। ক্ষুধার্তের যাতনা উপলব্ধির মাস। অন্যের প্রতি সদয় ও সহমর্মিতার মাস। সর্বোপরি মহান রবের পক্ষ থেকে পুরস্কার পাওয়ার মাস। হাদিসে রোজাদারদের জন্য দুটো পুরস্কারের কথা বলা হয়েছে। যার একটি হলো ইফতার। হাদিসের ভাষায়, ‘রোজাদারের জন্য দুটো আনন্দ: একটি ইফতার, অন্যটি রবের সাক্ষাৎ।’ (তিরমিজি: ৭৬৬)
সত্যিই ইফতার এক আনন্দময় মুহূর্ত। সারা দিনের ক্লান্তি নিমেষেই দূর হয়ে যায় ইফতারের সময়। প্রফুল্লতায় ভরে যায় দেহমন। একটি খেজুর অথবা এক চুমুক শরবতে হৃদয়ে যে প্রশান্তি নেমে আসে, তার তুলনা হয় কি? ইফতার করার মাধ্যমে যেমন ক্লান্তি–অবসাদ দূর হয়, তেমনি হালকা হয় গুনাহের বোঝা। হাদিসে এসেছে, ইফতারের আগ মুহূর্ত দোয়া কবুলের উত্তম সময়।
ইফতারের আরও বহু ফজিলত রয়েছে। এই ফজিলত আমরা নিজেরা ইফতার করে যেমন অর্জন করতে পারি। তেমনি অন্যকে ইফতার করানোর মাধ্যমেও পেতে পারি। একজন রোজাদার দিনভর রোজা রেখে যে নেকি অর্জন করবেন, সমপরিমাণ নেকি আমাদেরও অর্জিত হবে, যদি সেই রোজাদারকে ইফতার করাই। এমন সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করা যায়? তাই তো ইফতার করানোর পুণ্যময় সংস্কৃতি এখনো বিদ্যমান।
আমাদের দেশে এই সংস্কৃতি বিপুল উৎসাহ–উদ্দীপনায় পালিত হয়। রমজানে মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন করপোরেট অফিস, দোকানপাটে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা হয়। সেখানে সবাই মিলেমিশে ইফতার করেন। একে অন্যের কল্যাণ ও মাগফিরাতের দোয়া করেন। এ ছাড়া আত্মীয়স্বজন, পাড়া–প্রতিবেশীরা একে অন্যের বাড়িতে ইফতারি পাঠান। বিভিন্ন সেবামূলক সংস্থা পথচারী ও ছিন্নমূলদের ইফতারির ব্যবস্থা করে।
দেশে দেশে জারি থাকা এই সংস্কৃতির রয়েছে নানা নাম ও বৈচিত্র্য। আমাদের দেশের ‘ইফতার’ ব্রুনেইয়ে পরিচিত ‘সোংকাই’ নামে। ইন্দোনেশিয়ায় ইফতারকে বলা হয় ‘বুকা পুয়াসা’। এমনিভাবে ইফতারকে মালদ্বীপে ‘রোয়াদা ভিলান’ আর দুবাইয়ে বলা হয় ‘মেজে’। নামের সঙ্গে সঙ্গে উপাদানেও রয়েছে ভিন্নতার আমেজ। আমরা মুড়ি, ছোলা বুট, পেঁয়াজু ইত্যাদি তেলেভাজা দিয়ে ইফতার করলেও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ইফতার করা হয় কোনাফা, ত্রোম্বা, বিরিয়ানি, চিকেন রোল ও নানা রকম হালুয়া দিয়ে। থাকে সালাদ, স্যুপ, দুধ–দই ও বড় বড় রুটি। ভিন্নতা রয়েছে পশ্চিমের দেশগুলোর ইফতারেও। তবে সকল দেশ ও অঞ্চলেই খেজুরের প্রাধান্য রয়েছে।
খেজুর দিয়ে ইফতার করা সুন্নত। নবী (সা.) খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (সা.) নামাজের আগে কয়েকটি কাঁচা খেজুর খেয়ে ইফতার করতেন। যদি কাঁচা খেজুর না থাকত, তাহলে শুকনো খেজুর দিয়ে। যদি শুকনো খেজুরও না থাকত তাহলে কয়েক ঢোক পানি দিয়ে।’ (তিরমিজি: ৬৩২)
স্থান–কাল–পাত্র ভেদে আয়োজন ও উপাদানে ভিন্নতা থাকলেও আমাদের সবার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কিন্তু এক। আর তা হলো, মহান রবের সন্তুষ্টি অর্জন। এর জন্য খুব বেশি টাকা–পয়সা বা মেহনতের প্রয়োজন পড়ে না। নবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, সে ওই রোজাদারের সমপরিমাণ সওয়াব পাবে। এতে রোজাদারের সওয়াব কমানো হবে না।’ (তিরমিজি: ৮০৭)
এই বাণী শুনে সাহাবায়ে কিরাম বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আমাদের মধ্যে সবার তো রোজাদারকে ইফতার করানোর সামর্থ্য নেই।’ জবাবে নবী (সা.) বলেছেন, ‘যে কেউ কোনো রোজাদারকে একটি খেজুর দিয়ে বা পানি পান করিয়ে অথবা এক ঢোক দুধ দিয়ে ইফতার করাবে, মহান আল্লাহ তাকে এই সওয়াব দান করবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে পরিতৃপ্ত করে খাওয়াবে, মহান আল্লাহ তাকে কিয়ামতের দিন আমার হাউস থেকে এমন শরবত পান করাবেন, জান্নাতে প্রবেশের আগে তার আর পিপাসা লাগবে না।’ (শুআবুল ইমান: ৩৩৩৬)
লেখক: খতিব, কসবা জামে মসজিদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া