মূল লেখায় প্রবেশের আগে ধারণা তৈরির জন্য পেছনের গল্পটা বলি শুরুতে। স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশ রেলওয়েতে যাত্রীবাহী কোচের সংখ্যা ছিল ১৬৪৩টি। সেই সময় সাড়ে ৭ কোটি জনগণের জন্য তা যথেষ্ট ছিল বলে মনে করেছেন রেল কর্মকর্তারা।
স্বাধীনতার এত বছরে দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি, বর্তমানের প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যা আমাদের। অথচ বিপুল এই জনসংখ্যার বিপরীতে রেলের যাত্রীবাহী কোচ বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে কোচের সংখ্যা ১৯৫২টি।
এই কোচ দিয়ে সারাদেশে ৩৩৬টি ট্রেন পরিচালনা করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এসব ট্রেনের আন্তনগর সার্ভিসগুলোয় রেলের মোট আসন সংখ্যা ১ লাখ ৩৩ হাজার ৪৩৮টি। আর স্ট্যান্ডিং মেইল, কমিউটার ও লোকাল সার্ভিস মিলিয়ে প্রতিদিন আরও প্রায় লাখখানেক যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা রয়েছে রেলের।
জানিয়ে রাখছি, অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ সামলাতে প্রতিটি আন্তনগর ট্রেনের মোট আসনের ২৫ শতাংশ স্ট্যান্ডিং টিকিট বিক্রি করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। বৈধভাবে প্রতিদিন প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার যাত্রী গন্তব্যে নিয়ে যেতে পারার সক্ষমতা রয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ের। তবে রেলের বাণিজ্যিক বিভাগের তথ্য বলছে, প্রতিদিন গড়ে ৫ লাখ যাত্রী ট্রেনে যাতায়াত করে। অর্থাৎ স্ট্যান্ডিংসহ রেলের সক্ষমতার দ্বিগুণ যাত্রীর চাহিদা রয়েছে ট্রেনগুলোয়।
ঈদ, পূজা বা অন্যান্য উৎসবে ছুটির সময় এই চাহিদা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। সেই সময় তা আর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। তখন প্রতিটি ট্রেন যাত্রীতে পূর্ণ থাকে। পা ফেলার জায়গা থাকে না ট্রেনগুলোয়। দরজা, জানালা যে যেদিক দিয়ে পারেন ট্রেনে প্রবেশের চেষ্টা করেন। এই সময় ছাদে উঠতে দেখা যায় যাত্রীদের।
২০২৩ সালে অসংখ্য যাত্রীর চাপে ঢুকতে না পেরে উত্তেজিত জনতা বিমানবন্দর রেলস্টেশন ভাঙচুরের ঘটনা ঘটান। এতে চুরমার হয়ে যায় স্টেশনের প্রবেশ গেটসহ মূল্যবান সব স্থাপনা। পরে রেল কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে বিনা টিকিটের যাত্রীদের স্টেশনে প্রবেশ ও ট্রেনে উঠতে দেয়। অর্থাৎ বিশেষ সময়গুলোয় যাত্রীদের নিয়ন্ত্রণ করার সক্ষমতাও নেই রেলের।
অতিরিক্ত যাত্রীর চাপে ২০২৩ সালে লালমনিরহাট এক্সপ্রেস ট্রেনের চাকার স্প্রিং ভেঙে যায়, ফলে ট্রেন সারিয়ে যাত্রা করতে সময় লাগে ৫ ঘণ্টা। ঈদ, পূজা বা যেকোনো উৎসবের সময় ট্রেনের টিকিট যেন সোনার হরিণ। স্বল্প টিকিটের শতভাগই আবার অনলাইন ফলে টিকিট নিয়েও চলে শুভঙ্করের ফাঁকি।
২০২৪ সালের ঈদের টিকিট বিক্রির ঝামেলা কমাতে বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে বাড়েনি ট্রেন কিংবা আসন সংখ্যা অর্থাৎ আগের যে চিত্র তা বহাল থাকছে। এবার অতিরিক্ত চাহিদা পূরণে মাত্র ৮টি স্পেশাল ট্রেন চালানোর পরিকল্পনা করছে রেল। কোচ আর ইঞ্জিন সংকটের কারণে ইচ্ছা থাকলেও বেশি ট্রেন চালানো সম্ভব হচ্ছে না।
এবার ঢাকা থেকে আন্তনগর ট্রেনগুলোয় ঈদ স্পেশালসহ প্রতিদিনের বরাদ্দ মোট ৩৩ হাজার ৫০০ টিকিট। অথচ রেলের বাণিজ্য বিভাগ বলছে, ঈদযাত্রায় প্রতিদিন ঢাকা ছাড়বে রেলপথে অন্তত দেড় লাখ মানুষ। আর শেষের দুই তিনদিনে ঢাকা ছাড়বে গড়ে দুই লাখেরও বেশি যাত্রী।
তাহলে বিপুল সংখ্যক যাত্রীর জন্য নেই আসন ব্যবস্থা। ফলে এবারও যাত্রায় হবে ভোগান্তি। ছাদে কিংবা গাদাগাদি করে হবে এবারের ট্রেনযাত্রা। মানে আপনি বৈধযাত্রী হয়েও ভিড়ের কারণে আসনে যেতে পারবেন না। এমনকি অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে আপনি ট্রেনে ওঠার সুযোগ নাও পেতে পারেন।
তাহলে সক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী কীভাবে যাতায়াত করে ট্রেনে? প্রশ্নের উত্তর হলো, সবাই রেলের বিভিন্ন পর্যায়ে ট্রেনে দায়িত্বরত কর্মীদের টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে, সেই টাকা চলে যায় রেলকর্মীদের পকেটে। যেহেতু আসনের চেয়ে যাত্রী চাহিদা ব্যাপক এই সুযোগে অবৈধ যাত্রী নিয়ে গড়ে উঠে সিন্ডিকেট। যারা প্রতিদিনই লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।
আন্তনগর ট্রেনগুলোর খাবারের কেবিন, নামাজ ঘর, দরজার ফাঁকা স্থান, এসি কামরা কিংবা এসি করিডোর সব জায়গায় মেলে বিনা টিকিটের যাত্রী। টিকিট ছাড়া যেখানে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মেই প্রবেশ করতে পারার কথা না, সেইখানে পুরো ট্রেনকেই যেন দখল করে রাখে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীরা।
এই সিন্ডিকেট কাজ শুরু করে একেবারে স্টেশন থেকেই। টিকিট না থাকা যাত্রীদের সেইখান থেকেই সংগ্রহ করা হয়, এরপর রেল পুলিশ, স্টুয়ার্ট, আরএনবি, ট্রেনের গার্ড, টিটিই কিংবা টিসিদের সাহায্যে তোলা হয় ট্রেনে। এই অবৈধ যাত্রীদের চাপে স্বস্তির বাহন বিড়ম্বনায় পরিণত হয়েছে আসন প্রাপ্ত যাত্রীদের কাছে। সিন্ডিকেটের সব সদস্যরা ভাগ করে নেন পুরো টাকা।
ঢাকার দুই স্টেশনে তিন স্তরের চেকিং ব্যবস্থা রয়েছে, তবুও সেইখানে হরহামেশায় বিনা টিকিটে ঢুকে পড়ছেন যাত্রীরা। ঢাকার বাইরের স্টেশনগুলোয় এত চেকিংয়ের ব্যবস্থা নেই, বেশিরভাগ স্টেশনই খোলামেলা বাউন্ডারি প্রাচীর পর্যন্ত নেই। ফলে এসব স্টেশন দিয়ে প্রতিদিন শত শত যাত্রী বিনা টিকিটেই উঠে পড়েন ট্রেনে।
বিনা টিকিটের যাত্রী শনাক্ত করার জন্য থাকেন ভ্রাম্যমাণ টিকিট পরীক্ষক-টিটিই, সারাদেশে বর্তমানে টিটিই আছে মাত্র ২১৫ জন। অথচ টিটিই দরকার প্রায় ৫০০ জন। একটি ট্রেনে তিনজন টিটিই’র দরকার হলেও কোনো কোনো ট্রেনে টিটিই নেই ফলে অন্যান্য রেলকর্মীরা বিনা টিকিটের যাত্রী নিয়ে গড়ে তুলেছেন বিশাল বাণিজ্য।
এই মুহূর্তে সারাদেশ ৩১৩টি রেলস্টেশনে টিকিট বিক্রি করে বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং এই স্টেশনগুলোয় যাত্রী ওঠা-নামা করেন। ৩১৩টি স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম এলাকায় টিকিট চেক করার জন্য রয়েছে মাত্র ৭ জন টিসি। সুতরাং বিনা চেকিংয়ে কোনো বাঁধা ছাড়াই প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে ট্রেনে উঠেছেন অবৈধ যাত্রীরা।
আবার ভেতরেও তাদের চেক করার জনবল না থাকায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পার পেয়ে যাচ্ছেন তারা। তবে কেউ কিন্তু বিনা টাকায় গন্তব্যে পৌঁছান না, সবাই যেভাবে পারেন রানিং স্টাফদের ম্যানেজ করে যাতায়াত করেন। চলন্ত ট্রেনে দায়িত্ব পালন করা অ্যাটেন্ডেন্ট থেকে শুরু করে অন্যান্য পর্যায়ের রেলকর্মীরা টিকিট ছাড়া যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করেন টিকিটের সম-পরিমাণ ভাড়া। সেই টাকা প্রতি ট্রিপে তারা ভাগ করে নেন। এমন অভিযোগ যেকোনো রেলযাত্রীর। প্রতিটি ট্রেন যেন অবৈধ আয়ের মেশিনে পরিণত হয়েছে।
প্রতিবছর কী পরিমাণ টাকা রেলকর্মীরা হাতিয়ে নিচ্ছেন তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও ধারণা করা যেতে পারে ২০২৩ সালে রেলের ঢাকা বিভাগীয় বাণিজ্যিক বিভাগের হিসাব থেকে।
ঢাকা বিভাগে টিটিই দরকার ২৭০ জন, আছে মাত্র ৭০ জন। ঢাকা বিভাগে ১২৭ জন টিসি দরকার হলেও আছে মাত্র ২ জন। কী ভয়াবহ জনবল ঘাটতি তা সহজেই বোঝা যায়। এত প্রবল জনবল ঘাটতি নিয়ে ২০২৩ সালে অবৈধ বিনা টিকিটের যাত্রীদের কাছ থেকে ২০ কোটি টাকা আয় করেছে বাণিজ্যিক কর্মকর্তা শাহ আলম কিরণ শিশির। তার দাবি, বিনা টিকিটের যাত্রীদের কাছ থেকে তিনি যা আয় করেছেন আরও দ্বিগুণ আয় সম্ভব যদি জনবল ঘাটতি পূরণ হয়।
ঢাকার স্টেশনগুলো এত সুরক্ষিত হওয়ার পরও যদি এই অবস্থা হয় তাহলে ঢাকার বাইরের স্টেশনগুলোয় এর পরিমাণ বাড়বে বহুগুণ। সব মিলিয়ে রেলের ধারণা প্রতি বছর অন্তত ১৫০ কোটি টাকা বাড়তি আয় সম্ভব। এই হিসাব থেকে সহজেই অনুমেয় প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ রেলকর্মীদের পকেটে ঢুকছে অথবা তাদের গাফিলতিতে হারাচ্ছে সরকার।
আবার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দায়িত্বপ্রাপ্তরা টিকিট বাবদ যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা না দিয়ে ভরছেন নিজেদের পকেটে ফলে প্রতি বছরই ভারি হচ্ছে রেলের লোকসানের পাল্লা।
নাজমুস সালেহী ।। গণমাধ্যমকর্মী