চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেছেন, আইনের মধ্যে যথেষ্ট ফ্লেক্সিবিলিটি (নমনীয়তা) থাকতে হবে। কারণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি পরিবর্তনের প্রয়োজন হতে পারে। তবে যেখানে রেগুলেট করব সেখানে একটু শক্ত থাকব।
আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসির) সম্মেলন কক্ষে এআই আইন প্রণয়নে অংশীজনদের নিয়ে প্রারম্ভিক সংলাপে আইনমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
আইনমন্ত্রী বলেন, এআইয়ের ব্যাপ্তি অনেক বড়। এটার যেমন ভালো দিক আছে। তেমন খারাপ দিকও আছে। তবে এ জন্য ভীত হওয়ার কিছু নাই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নীতিমালা ও আইনের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে।
আইনমন্ত্রী আরও বলেন, ‘অন্যান্য আইনের ক্ষেত্রে আগে খসড়া দাঁড় করিয়ে তারপর আপনাদের মন্তব্য নেওয়া হয়। কিন্তু এখন আপনাদের সুপারিশ নিয়ে ড্রাফট করতে চাই। সেই কারণেই আমরা আপনাদের কাছে বসেছি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আইন-২০২৪ প্রণয়নের জন্য একটি আউটলাইন ড্রাফট তৈরি করে আবারও অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে।’
নিয়ন্ত্রণ, উদ্ভাবন, সম্প্রসারণ এবং সমন্বয় সাধন এই বিষয়গুলোকে মাথায় রেখে আইন প্রণয়নের দিকে আগাতে হবে উল্লেখ করে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, ‘সমন্বিত উদ্যোগ যাতে থাকে। তাহলে সফলভাবে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব।’
জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় সচেতনতা তৈরি করতে না পারলে ব্যাপক ঝুঁকি রয়েছে। তাই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এই সময়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ঝুঁকি ও সম্ভাবনা মাথায় রেখে একটি আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যে ঝুঁকি সেটি মোকাবিলা করা এবং সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোই হবে এই আইন প্রণয়নের মূল উদ্দেশ্য।
প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ‘ডিপ ফেক ভিডিও বা কণ্ঠস্বরের ক্লোনিং করে অসংখ্য অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে। যা শুধুমাত্র জাতীয় নিরাপত্তায় নয় বরং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি। কর্মদক্ষতা বাড়ানোর জন্য এবং নির্ভুল কাজের জন্য আমরা এআই ব্যবহার করতে পারি। কিন্তু এর অনেক অনেক অনৈতিক ব্যবহারও আছে। আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় উদ্ভাবন ও উন্নয়ন আরও বাড়াতে চাই। সে লক্ষ্য নিয়েই কাজ করা হচ্ছে।’
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের এআইয়ের সুবিধাগুলো নিতে হবে। পাশাপাশি এর খারাপ দিকগুলো নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রাখতে হবে।’
নৈতিকতা, সংস্কৃতি, ধর্মীয় ও জাতীয় মূল্যবোধে ভিত্তিতে এআই আইন প্রণয়নের পরামর্শ দেন বিটিআরসি মহাপরিচালক মোহাম্মদ খলিল-উর-রহমান। তিনি বলেন, ‘এআই আমার কাছে ভয়ংকর সুন্দর। তাই, নৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও জাতীয় মূল্যবোধ বিবেচনায় নিয়ে এআই আইন করা দরকার।’
একটি দুর্ঘটনার জন্য দায়ী কে হবেন সেটি সুনির্দিষ্ট করারও পরামর্শ দেন তিনি।
মাইক্রোসফট বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইউসুপ ফারুক বলেন, ‘আমাদের শিল্পের সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় নিয়ে এআই আইন করা উচিত হবে। বৈশ্বিক বিবেচনায় দায়িত্বশীল এআই জরুরি। ফান্ডামেন্টাল জেনারেল ইউজের ক্ষেত্রে সুযোগ রাখতে হবে। বৈশ্বিক যে ৬টি প্রিন্সিপাল রয়েছে সে বিষয়টি নিশ্চিত করে এআই আইন করতে হবে। অষ্টম শ্রেণি থেকেই পাঠ্যক্রমে এআই অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।
টিআরএনবি সভাপতি সাংবাদিক রাশেদ মেহেদী বলেন, এআই একটি কম্পোজিট বিষয়। তাই এই আইন অনলাইনের পাশাপাশি অফলাইন বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। বেশির ভাগ ডিপফেইক হয় করপোরেট লেভেলে। অপরাধের ক্ষেত্র সুনির্দিষ্ট করতে হবে। নিরপরাধ কেউ যাতে শাস্তি না পান সেটি লক্ষ্য রাখার পরামর্শ দেন তিনি।
বেসিস সভাপতি রাসেল টি আহমেদ বলেন, এআই আশঙ্কা না সম্ভাবনা তা নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলা দরকার। বিশ্বজুড়েই গর্ভের সন্তান ছেলে না মেয়ে তা নির্ণয় বন্ধ করার মতো এআই নিয়ন্ত্রণ করার কথা ভাবা হচ্ছে।
ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্ড কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য সুলতান আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, ‘এআইয়ের ইথিক্যাল ইস্যু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ইউজিসি-তে এ বিষয়ে আলোচনা পরে লিখিত মতামত দেব।’
সভায় সরকারি বেসরকারি নানা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও সংগঠনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে আলোচকেরা আরও বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে মানুষ যাতে চাকরি না হারায়। যাতে নতুন চাকরির ক্ষেত্র তৈরি হয়। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টিত সর্বজনীন ন্যূনতম ভাতা যেন থাকে। এ ক্ষেত্রে যারা চাকরি হারাবে, তারা পরবর্তী চাকরি না পাওয়ার আগ পর্যন্ত ভাতা পাবেন। বিভিন্ন সময় সরকারি মন্ত্রণালয় থেকে তথ্য ফাঁস হয়ে থাকে, তথ্য যাতে লিক না হয় সে বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
সব আইনগুলোকে ডিজিটাল করার পরামর্শ দিয়ে আলোচকেরা বলেন, ‘তাহলে আমরা সহজেই বুঝতে পারব কোন আইনের সঙ্গে কোনটা সাংঘর্ষিক। আবার আমরা কত দিন বাইরের এআই ব্যবহার করব।’ স্থানীয় সমস্যা দূর করার জন্য স্থানীয় অবকাঠামো দরকার বলেও আলোচনায় উঠে আসে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চলে আসায় ছাত্রছাত্রীরা শর্টকাট এপ্লাই করছে। এতে তাদের প্রকৃত জ্ঞানের বিকাশ হচ্ছে না। তাই এখানে অবশ্যই প্রোটেকশন দরকার বলে মত দেন অনেকে। এ ছাড়া তাড়াহুড়া না করে, সময় নিয়ে আইনটি করার পরামর্শ দেন অংশীজনরা।
এআই আইনের বিষয়ে প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে প্রাথমিক ধারণা দেন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের ইডিজি প্রকল্প পরিচালক আব্দুল বারী।
এছাড়াও অনুষ্ঠানে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব মো. সামসুল আরেফিন, আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মো. গোলাম সারওয়ার উপস্থিত ছিলেন।