প্রায় সাড়ে ছয় বছর আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিস্তা নদীর পানি সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্প প্রণয়নের জন্য চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, যাতে ‘চীনের দুঃখ’ হিসেবে একদা বিশ্বের বহুল পরিচিত হোয়াংহো নদী বা ইয়েলো রিভারকে চীন যেভাবে ‘চীনের আশীর্বাদে’ পরিণত করেছে, ওই একই কায়দায় বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর জনগণের জন্য প্রতিবছর সর্বনাশ ডেকে আনা তিস্তা নদীর পানি ব্যবস্থাপনাকেও একটি বহুমুখী প্রকল্পের মাধ্যমে আধুনিকায়ন করা যায়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে সাড়া দিয়ে সম্পূর্ণ চীনা অর্থায়নে প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পর প্রকল্প-প্রস্তাবটি চীনের পক্ষ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। চীন প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার যে প্রস্তাব দেয়, বাংলাদেশ তা গ্রহণ করেছিল বলেও জানা যায়। প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পে বাংলাদেশের সীমানার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা নদীর ১১৫ কিলোমিটারে ব্যাপক খনন চালিয়ে নদীর মাঝখানের গভীরতাকে ১০ মিটারে বাড়িয়ে ফেলা হতো এবং নদীর প্রশস্ততাকে ব্যাপকভাবে কমিয়ে ফেলা হতো। একই সঙ্গে রিভার ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে ব্যাপক ভূমি উদ্ধার করে চাষাবাদের সুযোগ সৃষ্টি করা হতো। নদীর দুই তীর বরাবর ১১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের চার লেনের সড়ক নির্মাণ করা হতো। উপযুক্ত স্থানে বেশ কয়েকটি ব্যারাজ-কাম-রোড নির্মাণ করে নদীর দুই তীরের যোগাযোগ নিশ্চিত করার পাশাপাশি বর্ষাকালে প্রবাহিত নদীর বিপুল উদ্বৃত্ত জলরাশি সংরক্ষণের জন্য জলাধার সৃষ্টি করে সেচখাল খননের মাধ্যমে নদীর উভয় তীরের এলাকার চাষযোগ্য জমিতে শুষ্ক মৌসুমে সেচের ব্যবস্থা গড়ে তোলা হতো। উপরন্তু নদীর উভয় তীরের সড়কের পাশে ব্যাপক শিল্পায়ন ও নগরায়ণ সুবিধাদি গড়ে তোলা হতো।
ইন্টারনেটে প্রস্তাবিত প্রকল্পটির বর্ণনা জেনে আমার মনে হয়েছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সত্যি সত্যিই তিস্তা প্রকল্প বাংলাদেশের সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর জনজীবনে একটা যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটাতে সমর্থ হতো।
প্রথম থেকেই এই প্রকল্পে বাগড়া দিচ্ছে ভারত। ভারতের দাবি, তাদের শিলিগুড়ি করিডরের ‘চিকেন নেকের’ এত কাছাকাছি তিস্তা প্রকল্পে কয়েক শ বা হাজারের বেশি চীনা নাগরিকের অবস্থানকে ভারত মেনে নেবে না। অতএব, বাংলাদেশকে এই প্রকল্প থেকে সরে আসতে বলা হচ্ছিল। একবার শোনা গিয়েছিল, ভারতের নিরাপত্তা-সম্পর্কীয় উদ্বেগকে আমলে নিয়ে সীমান্ত-নিকটবর্তী ১৬ কিলোমিটার নদীর খনন বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে করবে। সরকারের প্রতি আমার অনুরোধ ছিল, যেহেতু ভারতের ‘শিলিগুড়ি চিকেন নেক’ এবং ‘সেভেন সিস্টার্সের’ ভূরাজনৈতিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার অভিযোগ তুলে চীনের অর্থায়নের ব্যাপারে ভারত প্রকল্পের বিরোধিতা করছে, তাই মহাপরিকল্পনার বিভিন্ন ডাইমেনশনকে কাটছাঁট করে শুধু নদী খনন, ভূমি উদ্ধার, নদীপারের দুই পাশের পরিবর্তে আপাতত একপাশে মহাসড়ক নির্মাণ, নগরায়ণ ও শিল্পায়ন সুবিধা গড়ে তোলা পরবর্তী সময়ের জন্য রেখে দিয়ে বর্তমান পর্যায়ে শুধু জলাধার নির্মাণ, ব্যারাজ নির্মাণ, সেচখাল খনন ও সেচব্যবস্থা চালু করার বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে, প্রকল্পের রি-ডিজাইন করে নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়ন অবিলম্বে শুরু করা হোক। আমরা যদি প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার খরচ করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন করে বিশ্বব্যাংককে দাঁতভাঙা জবাব দিতে পারি, তাহলে রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার মতো দেশের সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত পাঁচটি জেলার এক কোটির বেশি মানুষের জীবন ও জীবিকার জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে করতে পারব না কেন? রিভাইজড ডিজাইনে প্রকল্পের খরচ এক-তৃতীয়াংশের মতো কমে আসত। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ভারতের দাদাগিরির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সর্বোত্তম উপায় হতো নিজস্ব অর্থায়নে তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা। কিন্তু চীনকে এই প্রকল্প থেকে বের করার উদ্দেশ্যে ভারত আগ বাড়িয়ে তিস্তা প্রকল্পে তাদের অর্থায়ন ও অংশগ্রহণের প্রস্তাব বাংলাদেশ সরকারকে গছানোর জন্য জোরেশোরে হাত-মোচড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। (এবারের শেখ হাসিনার ভারত সফরে স্বাক্ষরিত সবগুলো চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে ভারতকে একতরফা সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত নগ্নভাবে ধরা পড়েছে বলে আমি মনে করি। রেলওয়ে ট্রানজিট, ফারাক্কা চুক্তির নবায়ন সম্পর্কে দুই বছর আগে থেকেই আলোচনা শুরু, ফারাক্কা ও তিস্তা প্রকল্প সম্পর্কে দু-দুটো টেকনিক্যাল টিম পাঠানোর ভারতীয় একতরফা-প্রস্তাব, নেপাল থেকে ভারত হয়ে বিদ্যুৎ আমদানি—প্রতিটি ব্যাপারে ভারতের স্বার্থরক্ষাই প্রাধান্য পেয়েছে)।
তিস্তা নদী ঐতিহাসিকভাবেই অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং খামখেয়ালি আচরণের একটি নদী, যার বন্যার কবলে পড়ে প্রায় প্রতিবছর বর্ষায় বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল একাধিকবার বিধ্বস্ত হয়ে চলেছে। আবার শুষ্ক মৌসুমে তুলনামূলকভাবে খরাগ্রস্ত এই এলাকার মানুষ তিস্তা নদীর পানিস্বল্পতাহেতু সেচসুবিধা থেকেও বঞ্চিত থাকে। তিস্তা নদীর উজানে পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবায় ভারত একতরফাভাবে বাঁধ নির্মাণ করে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানি সম্পূর্ণভাবে আটকে দেওয়ার পর তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশ বছরের বেশির ভাগ সময় প্রায় পানিশূন্য থাকছে। ২০২৪ সালেও তিস্তার পানিস্বল্পতার ব্যাপক অভিযোগ উঠেছে। বলা হয়, এলাকার জনগণের জীবন ও জীবিকার সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ তিস্তা নদী। বাংলাদেশ বন্ধুরাষ্ট্র হলেও একটি আন্তর্জাতিক নদীর উজানে এহেন একতরফা বাঁধ নির্মাণ কিংবা খাল খননের আগে ভারত একবারও বাংলাদেশের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার প্রয়োজন বোধ করেনি; বরং দীর্ঘ তিন দশকের কূটনৈতিক আলোচনার পথ ধরে যখন ২০১১ সালে দুই দেশ তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল, তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যায়-আবদারের কাছে নতি স্বীকার করে ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং চুক্তি স্বাক্ষর থেকে পিছিয়ে গিয়েছিলেন। আমার আশঙ্কা, যদ্দিন মমতা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী থাকবেন, তদ্দিন ন্যায্য শর্তে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের কোনো সম্ভাবনা নেই।
মনে হচ্ছে, তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়টি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর অ্যাজেন্ডায় অদূর ভবিষ্যতে থাকবেই না। অবশ্য তিস্তা চুক্তি আর প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্প মোটেও সাংঘর্ষিক নয়। তিস্তা চুক্তি হোক বা না হোক সংকুচিত ডিজাইনে হলেও তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন ওই অঞ্চলের জনগণের জীবন ও জীবিকায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে। চুক্তি হলে শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানিপ্রবাহ খানিকটা হয়তো বাড়বে, কিন্তু বর্ষায় গজলডোবা ব্যারাজের সব গেট খুলে দেওয়ায় এই অঞ্চলের জনগণ যে একাধিকবার বন্যায় ডুবছে, তার তো কোনো সমাধান হবে না! চীনের প্রস্তাবিত প্রকল্পের জলাধারগুলোর সংরক্ষিত পানি পরিকল্পিত সেচব্যবস্থায় ব্যবহৃত হলে হয়তো এই সমস্যার টেকসই সমাধান মিলত। ভারত নিশ্চয়ই চীনের প্রকল্প-প্রস্তাব অনুসরণ করবে না, তারা ব্যাপারটি নিয়ে নতুন খেলা শুরু করেছে। মনে হচ্ছে, তিস্তা অববাহিকার জেলাগুলোর জনগণের কপাল খারাপ, তারা হয়তো আবার ভারতের আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী ভূরাজনৈতিক নোংরা খেলার ঘুঁটিতে পরিণত হলো! চীনের প্রকল্প প্রস্তাবটির আশু বাস্তবায়নের জন্য দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি মানববন্ধন ও মিছিল হয়েছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস, ভারতের হাত মোচড়ানোর কাছে নতি স্বীকার ব্যতীত বাংলাদেশ সরকারের গত্যন্তর নেই।
লেখক: ড. মইনুল ইসলাম
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়