Sunday, November 24, 2024
spot_img
Homeমতামতকম ভর্তুকি কৃষিতে প্রভাব ফেলবে

কম ভর্তুকি কৃষিতে প্রভাব ফেলবে

স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর আমরা যে ক্ষুধামুক্ত এই বাংলাদেশ দেখতে পাচ্ছি, আমি মনে করি এর পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন বাংলাদেশের কৃষক। এ ছাড়া গবেষক, কৃষি উদ্ভাবন এবং সরকারি সহায়তায় বাংলাদেশে কৃষি খাত উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে

দেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে এবং ধানের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চার গুণ। সবজি, ফল, মাছ, মাংস, দুধ ও ডিম উৎপাদনেও ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে আমাদের দেশ। বাংলাদেশের কৃষি খাত বর্তমানে নগরায়ণ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যের চাহিদা বৃদ্ধির বাস্তবতা সামনে রেখে উন্নয়নের পথে অগ্রসর হচ্ছে।

বর্ধিত উৎপাদন, কৃষিপণ্যের গুণমানের প্রক্রিয়াজাতকরণ, জলবায়ু সহনশীল ফসল উদ্ভাবন এবং উন্নত কৃষি অনুশীলনসহ শস্য, উদ্যানবিদ্যা, প্রাণিসম্পদ, জলজ চাষ, সুনীল অর্থনীতির (ব্লু-ইকোনমি) বিকাশ এবং কৃষির আরও অনেক ক্ষেত্রে বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের।আমি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান যে স্বাধীন বাংলাদেশের কৃষির রূপান্তর, পরিবর্তনগুলো খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। সারা দেশের অসংখ্য কৃষকের কথা শুনতে পেরেছি।

সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের অঙ্গীকারে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য সংসদে বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। নতুন অর্থমন্ত্রীর প্রথম বাজেট আর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার ২১তম বাজেট। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কৃষিবিষয়ক পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪৭ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা; যা মোট বরাদ্দের ৫ দশমিক ৯৪ শতাংশ।

শস্য কৃষি খাতের জন্য রাখা হয়েছে মোট বরাদ্দের ৩ দশমিক ৪১ শতাংশ। আর ২ দশমিক ৪৫ শতাংশ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, বন ও পরিবেশ, ভূমি ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। গত বছরের তুলনায় কৃষিতে বরাদ্দ বেড়েছে। কিন্তু এবার বাজেটে কৃষি ভর্তুকির পরিমাণ ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ২৬১ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট থেকে ৮ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা কম। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি, সার ও কৃষিযন্ত্রের দাম বাড়ার কারণে উৎপাদন খরচ বেড়েই চলেছে। এ সময়ে ভর্তুকি হ্রাস খাদ্য উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

আমাদের প্রধান খাদ্য ভাতের জন্য ধানের উৎপাদন নির্ভর করছে ভর্তুকির ওপর। সার ও জ্বালানিতে সরকারের লাগাতার ভর্তুকিই কৃষককে ধান উৎপাদনে এখন পর্যন্ত প্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছে।

বিবিএসের হিসাবে, বাংলাদেশ বছরে ৩ কোটি ৮০ লাখ টনের মতো চাল উৎপাদন করে। ইউএসডিএর প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছর (২০২৩-২৪) শেষে বাংলাদেশে চালের উৎপাদন ৩ কোটি ৬৩ লাখ টনে দাঁড়াবে। একই সময়ে ভোগের পরিমাণ হবে ৩ কোটি ৭৬ লাখ টন; অর্থাৎ ভোগ আর উৎপাদনের মধ্যে পার্থক্য ১৩ লাখ টন। তবে আশঙ্কার কথা হচ্ছে, ধান উৎপাদন কৃষকের জীবনমান উন্নয়নে তেমন প্রভাব ফেলছে না।

আইএফপিআরআইয়ের ‘বাংলাদেশ অ্যাগ্রি ফুড সিস্টেম স্ট্রাকচার অ্যান্ড ড্রাইভার্স অব ট্রান্সফরমেশন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা যায়, এক দশকে (২০০৯-১৯) বাংলাদেশে জীবনমান উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে ভুট্টা, পাট, মাংস ও দুধ উৎপাদন। এরপরই রয়েছে কন্দাল ফসল, উদ্যান ফসল, ডাল ও তেল জাতীয় শস্য উৎপাদন এবং মৎস্য চাষ। তবে কৃষকের জীবনমানে সবচেয়ে কম প্রভাব ফেলছে ধান উৎপাদন। কৃষকের জীবনমান উন্নয়নে ধান উৎপাদনের স্কোর হয়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ১২।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকেরা জানিয়েছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে ধানের উৎপাদন ৪০ দশমিক ৭ মিলিয়ন টন, ২০৪০ সালের মধ্যে ৪৩ দশমিক ৯ মিলিয়ন টন ও ২০৫০ সালের মধ্যে ৪৬ দশমিক ৭ মিলিয়ন টনে উন্নীত করা সম্ভব। ২০৫০ সালে বাংলাদেশকে আনুমানিক ২১ কোটি ৫৪ লাখ মানুষের খাবারের জোগান দিতে হবে। বর্তমান চালের বার্ষিক ব্যবহার জনপ্রতি ১৪৮ কেজি, যা প্রতিবছর শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ করে কমছে। আশা করা হচ্ছে, ২০৪০ সালের মধ্যে জনপ্রতি বছরে ১৩৩ কেজি চাল প্রয়োজন হবে।বর্তমানে প্রতিবছর ধানের উৎপাদন শূন্য দশমিক ৩৪ শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই হারে বাড়তে থাকলে ২০৫০ সালে দেশে ধানের উৎপাদন ৪৭ দশমিক ২ মিলিয়ন টনে পৌঁছাতে পারে।

কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, ধান চাষের জমি কমে আসছে। কৃষকও ধান চাষ করতে আগ্রহী হচ্ছেন না। ধান উৎপাদনের বড় একটি জেলা নওগাঁ। সম্প্রতি দেখেছি নওগাঁয় ফল চাষের পরিমাণ বেড়েছে। নওগাঁ, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ধান চাষের বিশাল জমিতে চাষ হচ্ছে ফল-ফলাদির। বছরখানেক আগে মানিকগঞ্জে দেখেছি কৃষক ধান চাষের পরিবর্তে পেঁপে চাষ করছেন। কোনো কোনো কৃষক নিজের খাবারের জন্যও ধান চাষ করছেন না। এই পরিস্থিতিতে আমাদের ধানের উৎপাদন আদৌ বাড়বে কি না, সে আশঙ্কা রয়েছে। ফলে খাদ্যনিরাপত্তা দিন দিন হুমকির মুখে পড়বে কি না, তা-ও ভেবে দেখতে হবে।

বাংলাদেশে বছরে ৭০ লাখ টনের মতো গমের চাহিদা রয়েছে। আমদানি করতে হয় ৬০ লাখ টন। আর ১০ লাখ টনের মতো দেশে উৎপাদিত হয়। গম আমদানি রাতারাতি কমিয়ে ফেলা সম্ভব নয়। তবে বিপুল পরিমাণ জমি এখনো অনাবাদি আছে, আছে এক ফসলি জমি। সেগুলোকে চাষের আওতায় আনতে হবে। আগামীর টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে কৃষিতে ভর্তুকি বাড়াতে হবে।সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও সুকৌশলে কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়ানো হলে দেশ কৃষিতে এগিয়ে যাবে, নিশ্চিত হবে খাদ্যনিরাপত্তা।

কৃষিযন্ত্রে সরকারের ভর্তুকি বেশ কাজে এসেছে; বিশেষ করে হাওরাঞ্চলে সময়মতো ধান কাটায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু মাঠপর্যায়ে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, বড় বড় কৃষিযন্ত্র ভর্তুকি পাওয়ার পরও ক্ষুদ্র কৃষকের পক্ষে কেনা সম্ভব নয়।

ফলে যে ব্যক্তি ওই যন্ত্র কিনছে, ভর্তুকির লাভ সেই ব্যক্তিই এককভাবে পাচ্ছে। অথচ এই সময়ে নানা রকম ক্ষুদ্র কৃষিযন্ত্র তৈরি হয়েছে; যা চীনের কৃষি যন্ত্রমেলায় আমি দেখেছি। ক্ষুদ্র কৃষিযন্ত্রে ভর্তুকি দেওয়া গেলে ভর্তুকির ফল আরও বড় পরিসরে কৃষক পর্যায়ে পৌঁছাবে।পরিবর্তিত সময়ে যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া জরুরি তা হচ্ছে:

ক. উন্নত কৌশল এবং কৃষিযন্ত্র ব্যবহার করে কৃষিতে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য কৃষককে দক্ষ করে তোলা।

খ. বর্তমান বাজারমূল্য নির্ধারণ, ফসল সংরক্ষণের একটি সামগ্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং তা বিতরণের ব্যবস্থা পুনর্গঠন করতে হবে, যার লক্ষ্য মূলত খরচ কমানো বা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ঠেকানো এবং সাশ্রয়ী মূল্যে প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা।

গ. উৎপাদক এবং সরবরাহকারী হিসেবে কৃষকের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে।

ঘ. শস্যবিমা এবং চিকিৎসাবিমা উন্নীত করার পাশাপাশি কৃষকদের পেনশন প্রকল্পের একটি বৈশ্বিক মডেল বাংলাদেশে প্রবর্তন করতে হবে।

ঙ. বর্তমান নিরাপত্তাবেষ্টনী এবং সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি ক্রয়ক্ষমতার ভেতর খাদ্যপ্রাপ্যতার বিষয়টি নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।

চ. উন্নত কৃষি গবেষণায় মনোযোগ দিতে হবে; বিশেষ করে উন্নত স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তিভিত্তিক গবেষণার কথা বলছি।

ছ, বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ এবং কৃষি খাতে এর প্রায়োগিক ব্যবহারের জন্য কৌশলগত কাঠামো প্রয়োজন।

জ, কৃষিজমি এবং কৃষিসম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আইনি হস্তক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে।

ঝ. কৃষিপণ্যের জন্য করছাড় এবং বিভিন্ন শস্যের গুরুত্ব বিবেচনা করে বছরভিত্তিক প্রণোদনা দিতে হবে।

ঞ. দেশব্যাপী জাতীয় কৃষি প্রতিষ্ঠানগুলোর আন্তসম্পর্ক বৃদ্ধি করা।

১৯৬০-এর দশকে সবুজ বিপ্লব এসেছিল এবং এখন আরেকটি বিপ্লবের জন্য সেরা সময়, যার ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহার স্মার্ট এবং দক্ষ হতে হবে। ডিজিটাল দক্ষতা অর্জনে পর্যাপ্ত এবং কার্যকরী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে, যেগুলো কৃষকের জন্য বাস্তবসম্মতভাবে সহজ ও কার্যকরী হবে। এগুলো সম্ভব হলে, অর্থাৎ বাস্তবায়িত হলে আমরা একসঙ্গে একটি টেকসই বা মজবুত পথে হাঁটতে পারব বলে বিশ্বাস রাখি।

লেখক: শাইখ সিরাজ ,পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই

RELATED ARTICLES

Leave a reply

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments