Monday, September 16, 2024
spot_img
Homeবিশ্বইরানকে কোন পথে নেবেন সংস্কারপন্থি পেজেশকিয়ান?

ইরানকে কোন পথে নেবেন সংস্কারপন্থি পেজেশকিয়ান?

গত মে মাসে উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় নিহত ইব্রাহিম রাইসির স্থলাভিষিক্ত হিসেবে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে সংস্কারপন্থি মাসুদ পেজেশকিয়ানকে বেছে নিয়েছেন ইরানিরা। ৬৯ বছর বয়সী পেজেশকিয়ান পেশায় হৃদরোগবিষয়ক শল্যবিদ। দেশটির অতিরক্ষণশীল সাঈদ জালিলির বিরুদ্ধে রানঅফ নির্বাচনে সর্বোচ্চসংখ্যক ভোট পেয়েছেন তিনি। শুক্রবারের নির্বাচনে পড়া মোট ৩ কোটি ৬০ লাখ ভোটের প্রায় এক কোটি ৬০ লাখই পেয়েছেন ইরানের সংস্কারপন্থি আইনপ্রণেতা পেজেশকিয়ান। যা ভোটের হারে প্রায় ৫৪ শতাংশ।

তিনি দেশটির প্রধান সংস্কারপন্থি জোট ও অনেক ইরানির সমর্থন পেয়েছেন। যারা আবারও ইরানের ক্ষমতায় কট্টরপন্থীদের নিয়ন্ত্রণের আশঙ্কা করেছিলেন। নির্বাচনী প্রচারণার সময় পেজেশকিয়ান ‌‌‘‘ইরানকে বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্ত’’ করে পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে তেহরানের ‘‘গঠনমূলক সম্পর্ক’’ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পরাশক্তির সাথে ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন তিনি। ইরানের পারমাণবিক কার্যকলাপ সীমিত করতে দেশটির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি ছিল সেই চুক্তিতে। কিন্তু ২০১৮ সালে ওয়াশিংটন এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর সেটি ভেস্তে যায়।

২০২২ সালে হিজাব পরার বিধান লঙ্ঘনের অভিযোগে ইরানের নৈতিকতা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মাহসা আমিনি নামের এক তরুণী। পরে পুলিশি জিম্মায় নির্যাতনে ওই তরুণীর মৃত্যুর পর ইরানজুড়ে হিজাববিরোধী আইন শিথিলের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। এবারের নির্বাচনী প্রচারণায় নারীদের বাধ্যতামূলক হিজাব পরার বিধান কার্যকর করার জন্য পুলিশি টহলের ‘‘পুরোপুরি’’ বিরোধিতা করেছেন পেজেশকিয়ান। একই সঙ্গে ইরানে দীর্ঘদিন ধরে ইন্টারনেটের ওপর যে কড়াকড়ি আরোপ রয়েছে তা শিথিল করারও অঙ্গীকার করেছেন তিনি।

পেজেশকিয়ান তার সরকারে আরও বেশি নারী ও জাতিগত সংখ্যালঘু যেমন— কুর্দি এবং বেলুচদের অন্তর্ভুক্ত করার অঙ্গীকার করেছেন। তিনি মুদ্রাস্ফীতি কমানোর প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন; যা দেশটিতে বর্তমানে প্রায় ৪০ শতাংশে অবস্থান করছে। গত কয়েক বছরে মুদ্রাস্ফীতি দেশের মানুষের পিঠ দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।

অতিরক্ষণশীল সাঈদ জালিলির সাথে এক বিতর্কে পেজেশকিয়ান বলেছিলেন, ইরানের ২০০ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন। বিশ্বজুড়ে ইরানের সম্পর্কে সংশোধন আনার মাধ্যমেই এই বিনিয়োগ পাওয়া সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

অন্যান্য অনেক দেশের মতো ইরানের প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী নন এবং চূড়ান্ত কর্তৃত্ব দেশটির সর্বোচ্চ নেতার হাতে। আর সর্বোচ্চ নেতার পদে প্রায় ৩৫ বছর ধরে আছেন আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। প্রেসিডেন্ট হিসেবে পেজেশকিয়ান দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদাধিকারী হবেন। দেশের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতিতে তার প্রভাব থাকবে। অর্থনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ে নীতি নির্ধারণ তার ক্ষমতার আওতায় থাকবে।

তবে দেশটির পুলিশের ওপর তার সীমিত নিয়ন্ত্রণ থাকলেও সেনাবাহিনী ও ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) ওপর তার কোনও কর্তৃত্ব থাকবে না। কারণ দেশটির পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং আইআরজিসি সরাসরি সর্বোচ্চ নেতার কাছে জবাবদিহি করে। খামেনির নির্ধারিত রাষ্ট্রীয় নীতি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পাবেন পেজেশকিয়ান।

দেশটির পুলিশের ওপর প্রেসিডেন্ট হিসেবে পেজেশকিয়ানের সীমিত নিয়ন্ত্রণ থাকলেও সেনাবাহিনী ও ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) ওপর কোনও কর্তৃত্ব থাকবে না।

পেজেশকিয়ানের বিজয় নিয়ে ইরানিদের মাঝে মিশ্র অনুভূতি দেখা গেছে। কেউ কেউ আনন্দ প্রকাশ করলেও অনেকে সংশয়ে আছেন। তেহরানের বাসিন্দা ৪০ বছর বয়সী স্থপতি আবুল ফজল বলেন, ‘‘জনগণের অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের সত্যিই একজন শিক্ষিত প্রেসিডেন্টের প্রয়োজন।’’ ৪০ বছর বয়সী নরসুন্দর রাশেদ বলেন, পেজেশকিয়ানের জয় কোনও বিষয় নয়। বরং দেশের ‘‘পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে’’ বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তেহরানের এই বাসিন্দা।

ইরানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাংবাদিক মাজিয়ার খোসরাভি বলেন, নতুন প্রেসিডেন্ট ইরানের সমস্যাগুলো তাৎক্ষণিক সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেননি। তিনি বলেন, জনগণ তাকে ভোট দিয়েছে, কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল যে বিশ্বের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে পেজেশকিয়ানের আগ্রহ রয়েছে; যা বর্তমান সরকারের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি।

দেশটির রাজনৈতিক ভাষ্যকার মোসাদ্দেগ মোসাদেঘপুর বলেন, লোকজন অত্যন্ত সতর্কতার সাথে আশা করছেন যে, তিনি কিছু ভালো পরিবর্তন আনতে ও দেশের কিছু সমস্যার সমাধান করতে পারেন— বিশেষ করে অর্থনীতির। অন্যদিকে কিছু বিশ্লেষক বলছেন, পেজেশকিয়ান জটিল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবেন। কারণ এখনও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে রক্ষণশীলদের আধিপত্য রয়েছে।

এ রকম একটি প্রতিষ্ঠান হল সংসদ; যা গত মার্চ মাসে গঠন করা হয়েছিল। এই সংসদে রক্ষণশীল ও অতিরক্ষণশীলদের ব্যাপক আধিপত্য রয়েছে। সংসদের স্পিকার মোহাম্মদ বাঘের গালিবাফ প্রথম দফার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তিনি রানঅফ পর্বে জালিলিকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। এছাড়া প্রথম দফার ভোটের মাত্র একদিন আগে নির্বাচন থেকে বাদ পড়া অন্য দুই প্রার্থীও জালিলির প্রতি নিজেদের সমর্থন দিয়েছিলেন।

‘‘হিজাব কিংবা অন্য কোনও আদর্শিক বিষয় নিয়ে কাজের এখতিয়ার প্রেসিডেন্টের হাতে নেই,’’ বলেন মোসাদ্দেগ মোসাদেঘপুর। তিনি বলেন, এটা পুরোপুরি ধর্মীয় বিষয়।

আন্তর্জাতিক থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের আলী ওয়ায়েজ এএফপিকে বলেন, দেশের ভেতরে মানুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার এবং বিদেশে কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা নিয়ে কঠিন লড়াইয়ের মুখোমুখি হবেন পেজেশকিয়ান। পারমাণবিক ইস্যুতে পেজেশকিয়ান কিছুটা সমস্যার সমাধান করতে পারেন। তবে এক্ষেত্রেও সর্বোচ্চ নেতার ইচ্ছাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

ওয়াশিংটন ও ইউরোপের সাথে ইরানের স্বাক্ষরিত ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা বছরের পর বছর ধরে ব্যর্থ হয়েছে। মাজিয়ার খোসরাভি বলেছেন, ‘‘পররাষ্ট্রনীতিতে ইরানের দৃষ্টিভঙ্গি মৌলিকভাবে পরিবর্তন হবে বলে কারও প্রত্যাশা করা ঠিক হবে না।’’

তেহরানের মিত্র হামাসের সাথে ইসরায়েলের যুদ্ধ নিয়ে ব্যাপক আঞ্চলিক উত্তেজনার মাঝে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ইসরায়েলের সাথে যুদ্ধে ইরানের আঞ্চলিক মিত্র সিরিয়া, লেবানন, ইরাক এবং ইয়েমেনের সশস্ত্রগোষ্ঠীগুলোও জড়িয়েছে। মোসাদ্দেগ মোসাদেঘপুর বলেছেন, পেজেশকিয়ান ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা হ্রাস কিংবা প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর প্রতি তেহরানের সমর্থন বন্ধ করবেন না।

RELATED ARTICLES

Leave a reply

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments