Tuesday, November 26, 2024
spot_img
Homeজাতীয়ময়মনসিংহ সিটি নির্বাচনে বিপুল ভোটে টিটু ফের মেয়র

ময়মনসিংহ সিটি নির্বাচনে বিপুল ভোটে টিটু ফের মেয়র

ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন (মসিক) নির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতে আবারও মেয়র হয়েছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ইকরামুল হক টিটু। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা সাদেকুল হক খান মিল্কীর চেয়ে চার গুণ ভোট বেশি পেয়েছেন তিনি। স্থানীয় সরকারের এই ভোটে দলীয় প্রতীক বরাদ্দের সুযোগ থাকার পরও কৌশলগত কারণে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কাউকেই মনোনয়ন দেয়নি।

শনিবার রাতে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে ১২৮ কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে টেবিল ঘড়ি প্রতীকে টিটু পেয়েছেন ১ লাখ ৩৯ হাজার ৬০৮ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সাদেকুল মিল্কী হাতি প্রতীকে পেয়েছেন ৩৫ হাজার ৭৬৩ ভোট। ঘোড়া প্রতীকে এহতেশামুল আলম ১০ হাজার ৭৭৩ ভোট, হরিণ প্রতীকে ড. রেজাউল হক ১ হাজার ৪৮৭ ভোট ও শহিদুল ইসলাম লাঙ্গল প্রতীকে পেয়েছেন ১ হাজার ৩২১ ভোট। এ সিটিতে মোট ভোটার ৩ লাখ ৩৬ হাজার ৪৯৬।

বিএনপিসহ নিবন্ধিত অন্য দলগুলোর উল্লেখযোগ্য কোনো প্রার্থীও ছিলেন না এ নির্বাচনে। ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে আওয়ামী লীগ নিজ দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী সবাইকে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ করে দেয়। ফলে স্থানীয় এমপিসহ জেলা ও মহানগর কমিটি সাংগঠনিকভাবে কোনো প্রার্থীর পক্ষে এককভাবে অবস্থান নেওয়ার সুযোগও বন্ধ হয়ে যায়। এসব কারণে মেয়র পদে একতরফা ফলাফলের আভাস শুরু থেকেই মিলছিল। তবে প্রচারকালে নির্বাচন নিয়ে উচ্ছ্বাস দেখা না গেলেও ভোটার উপস্থিতি ছিল ৬০ শতাংশের মতো। মূলত কাউন্সিলর প্রার্থীরাই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতিতে বড় ভূমিকা রেখেছেন।

২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচনে ১৫৩ আসনে বিনা ভোটে এমপিদের জয়ের পর থেকেই ক্রমান্বয়ে স্থানীয় সরকারের ভোটে ভোটার উপস্থিতি কমতে শুরু করে, যা নিয়ে দেশে-বিদেশে নানা সমালোচনার মুখে পড়েন ক্ষমতাসীনরা। বিএনপিসহ রাজনীতিতে সক্রিয় নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর ধারাবাহিক ভোট বর্জনের মুখে আওয়ামী লীগ নিজ দলের একাধিক প্রার্থী দেওয়ার কৌশল নেয়। এর আগে গাজীপুর, বরিশাল, খুলনা, সিলেট ও রাজশাহীতেও একই পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ নিজ দলের মনোনয়নবঞ্চিতদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ করে দেয়।

এই ভোট নিয়ে শুরু থেকেই সদর আসনের এমপি মোহিত উর রহমান শান্তের সঙ্গে টিটুর স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল। যার শুরু দুই মাস আগের সংসদ নির্বাচন থেকে। এর রেশ পুরো জেলার রাজনীতিতে ছড়িয়ে পড়ে। গতকাল শনিবার সারাদিন এমপি শান্ত নগরীর নাটক ঘর লেনের বাসায় অবস্থান করলেও ভোট দিতে কেন্দ্রে যাননি। দুপুরের পরে সমকালের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, বিগত সংসদ নির্বাচনে তাঁকে সমর্থনকারীরা একাধিক মেয়র প্রার্থীর পক্ষে মাঠে ছিলেন। এ রকম পরিস্থিতি তিনি নিজের নিরপেক্ষ অবস্থান ধরে রাখতে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থেকেছেন।

২০১৮ সালে এই সিটি গঠিত হলেও প্রথম নির্বাচন হয় ২০১৯ সালে। আগের দুই মেয়াদে পৌর মেয়রের দায়িত্ব পালনকারী ইকরামুল হক টিটু নতুন সিটির প্রশাসক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৯ সালে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন তিনি। সিটির নাগরিক সেবা ও অন্যান্য উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়ে নগরবাসীর অনেক ক্ষোভ থাকলেও মেয়র পদে থেকে টিটু সব সময়ই নিজেকে জনসম্পৃক্ত রাখার চেষ্টা করছেন।

সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ১২৮ কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট নেওয়া হয়। পরে নগরীর টাউন হলের তারেক স্মৃতি মিলনায়তনে আনুষ্ঠানিকভাবে বিভিন্ন কেন্দ্রের বেসরকারি ফল ঘোষণা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. বেলায়েত হোসেন চৌধুরী। তবে ভোট শেষ হওয়ার দুই ঘণ্টার মধ্যেই টিটুর সমর্থকরা বিভিন্ন কেন্দ্রের ফল নিয়ে নগরীজুড়ে আনন্দ-উল্লাস শুরু করেন। নগরীর কালীবাড়ি রোডে তাঁর বাস ভবনে নেতাকর্মীর ভিড় বাড়তে শুরু করে।

মেয়র পদে একজন ছাড়াও ৩৩ সাধারণ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এবং ১১ সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের জন্য ভোট নেওয়া হয়। কাউন্সিলর পদে একটি ওয়ার্ডে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় বাকি ৩২টি কাউন্সিলর পদের জন্য লড়েন ১৪৯ জন। সংরক্ষিত ১১ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে প্রার্থী ছিলেন ৬৯ জন।  দিনভর নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি শান্ত থাকলেও সাধারণ ভোটারদের জন্য বিড়ম্বনার বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায় ইভিএম জটিলতা।

সকাল ৮টা থেকে কেন্দ্রগুলোতে শুরু হয় ভোট। নগরীর মহাকালী গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিতে প্রবেশ করেন নারীরা। এ প্রতিষ্ঠানটিতে ছিল নারীদের দুটি কেন্দ্র। এক কেন্দ্রের ভোটার ১৫৬০, অন্য কেন্দ্রে ২৪৬০ জন। তবে ইভিএমে অনভ্যস্ত ভোটারদের ভোট দিতে সময় বেশি লাগায়  ধীরগতি দেখা দেয়।

সকাল সাড়ে ৮টায় নগরীর প্রিমিয়ার আইডিয়াল স্কুল কেন্দ্রে ভোট দিতে এসেছিলেন কালীবাড়ি এলাকার বাসিন্দা শেফালী। তিনি বলেন, ‘ভোট দিতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। মেশিনে আঙুলের ছাপ ওঠেনি।’ তবে জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে এসে ভোট দিতে বলা হয়েছে তাঁকে।

কালীবাড়ি গুদারাঘাট এলাকার বাসিন্দা মনোয়ারা খাতুন বলেন, ‘আমাদের কামের হাত। পেঁয়াজ কাইট্টা আঙুলের দাগ মুইচ্ছা দেছে। অহন ভোট দিবার আইস্যা বিপদে পড়ছি। আঙুলের ছাপ আসে না। পরে কইছে আইডি কার্ড লইয়্যা আইতে।’ তবে একই কেন্দ্রে ইভিএমে প্রথম ভোট দিয়ে বেশ আপ্লুত বকুল বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘মেশিনে আমার ভোট দ্রুতই দিয়েছি।’ কেন্দ্রটির সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার কাজল চন্দ্র দাস বলেন, ‘নারী ভোটারদের আঙুলের ছাপ নিতে এতটু সমস্যা হওয়ায় কিছুটা সময় বেশি লাগছে।’

বেলা ১১টার দিকে ময়মনসিংহ পলিটিক্যাল ইনস্টিটিউট কেন্দ্রে প্রবেশমুখে ঘড়ি প্রতীকের সমর্থকদের স্লোগান দিতে দেখা যায়। এ সময় সেখানে এসে উপস্থিত হন আরেক মেয়র প্রার্থী  এহতেশামুল আলম। তিনি গাড়ি থেকে নামলে তাঁর সমর্থকরাও ঘোড়া প্রতীকের সমর্থনে স্লোগান দিতে থাকেন। উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা তাদের স্লোগান না দিতে এবং এতে আচরণবিধি লঙ্ঘিত হওয়ার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিলেও সমর্থকরা থামেননি।

এখানে দুটি কেন্দ্রের একটির প্রিসাইডিং কর্মকর্তা জানান, সকাল ১০টা পর্যন্ত ২১৩টি ভোট পড়েছে। ইভিএমের কারণে ভোট গ্রহণে কিছুটা সময় বেশি লাগছে।

জেলা পরিষদ স্কুল কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা সেলিম রেজা জানান, তাঁর কেন্দ্রে ২১৪৮ ভোটারের মধ্যে সকাল ১০টা পর্যন্ত ভোট পড়েছে ৩০১টি। সকাল থেকেই কেন্দ্রের একটি বুথের ইভিএমে ব্যালট ইউনিটের সংযোগ বারবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিল। ফলে ভোট নিতে জটিলতা দেখা দেয়। ইভিএম পরিবর্তনের পর নির্বিঘ্নে ভোট শুরু হয়। তিনি জানান, বেশ কয়েকজন ভোটারের ফিঙ্গার প্রিন্ট মেলাতে বেগ পেতে হয়েছে। এর মধ্যে কাউকে কাউকে আঙুল পরিষ্কার করে বিকেলে আবার ভোট দিতে আসার জন্য বলা হয়েছে।

ইভিএম জটিলতায় ভোগান্তির কথা জানিয়েছেন, এডওয়ার্ড ইনস্টিটিউটের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা শাজাহান করিম। তাঁর মতে, ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা বাছাইয়ে কমিশনের আরও যত্নবান হওয়া দরকার। ঢালাওভাবে গ্রেডিং বিবেচনায় কর্মকর্তা নিয়োগ করা ঠিক নয়। কারণ, অনেক কর্মকর্তা ইভিএম পরিচালনায় অনেক সহজ বিষয়কে জটিল করে ফেলছেন। ফলে সাধারণ ভোটাররা হয়রানির শিকার হয়েছেন।

এই কেন্দ্রে অনেক নারী ভোটারের হাতে মার্কার দিয়ে দাগ দেওয়া হচ্ছে– এর কারণ জানতে চাইলে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা শাজাহান করিম জানান, অনেক ভোটার দাগ দেওয়ার জন্য নিজেরাই বলেন। কারণ, তিনি যে ভোট দিয়েছেন, এটা তার প্রমাণ। এই প্রমাণ তাদের আশপাশের মানুষকে দেখাতে হবে।

প্রিসাইডিং কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপের মধ্যেই তাহমিনা আক্তার নামে এক তরুণী এসে অভিযোগ করেন, তাঁর ভোট অন্য একজন দিয়ে ফেলেছে। তিনি জীবনে প্রথম ভোট দিতে এসেছেন, এখন বিকল্প কোনো ব্যবস্থা আছে কিনা। তবে ইভিএমে একজনের ভোট আরেকজন দেওয়া প্রায় সম্ভব বলে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা বিষয়টি আরও ভালো করে বোঝার চেষ্টা করলেন। পরে জানা গেল, তাহমিনার আগের ভোটার গোপন কক্ষে ঢুকে ভোট দেওয়ার নিশ্চিত না হতে পেরে বাটনগুলো চাপাচাপি করছিলেন।

অন্যদিকে, পোলিং কর্মকর্তারা তাহমিনার ফিঙ্গার প্রিন্ট মেলাতেই আরেকটি ব্যালট ওপেন হয়ে যায়। তবে আগের ভোটার ভোট সম্পন্ন হওয়ার পরও বাটন চাপাচাপি করছিলেন, সেটা অন্যরা খেয়াল করেননি। ফলে তাহমিনার জন্য ওপেন করা ব্যালটটিতে আগের ভোটারের দ্বিতীয় ভোট দেওয়া হয়ে যায়। পরে হতাশা নিয়ে কেন্দ্র থেকে ফিরে যান তাহমিনা।

ভোট দিতে না পেরে ফিরে যাওয়ার সময় কথা হয় কালীবাড়ি এলাকার ৫৬ বছর বয়সী ভোটার রাহেলা আক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সকাল সাড়ে ৭টার সময় ভোট দিতে আইছি। লাইনে দাঁড়ায়া থাইক্যা ৯টার দিকে ভোট দিতাম ঢুকলাম। পরে হেরা কয় ফিঙ্গার মিলে না। কইনছেন দেহি, এইটা কি আমার দোষ।’

ক্ষোভ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘হেরা ভোটের মেশিন ঠিক না রাইখ্যা ভোট নিতাছে কেন। আমার জাতীয় পরিচয়পত্র, ভোটের কার্ডটাতো ঠিকই আছে। আমার ভোটটা দিতাম পারলাম না। এইডার জবাবডা কেডা দিব।’

RELATED ARTICLES

Leave a reply

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments