বুর্জোয়ারা যে নির্বাচন দিয়ে থাকে; তাদের জন্য সেটা এক ধরনের খেলা বৈ কিছু নয়। বুর্জোয়ারাই খেলে এবং তারাই জেতে– এনামে ওনামে। প্রতীক ভিন্ন ভিন্ন, কিন্তু পরিচয় অভিন্ন। জনগণকে ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। জনগণ ভোট যে দেয় না, তাও নয়। কিন্তু একেবারে অবধারিতভাবেই হেরে যায় ওই জনগণ।
বাংলাদেশেও একটি নির্বাচন আমরা দেখলাম। কারা জিতবে– সেটা তো জানাই ছিল। বুর্জোয়াদের তো বটেই, সরকারি দলেরই জিতবার কথা, জিতেছেও; আগে যেমন জিতেছে, এবারও তেমনি; কৌশলেরই যা অল্পস্বল্প ইতরবিশেষ ঘটেছে। সরকারি দলের প্রধান মুখপাত্র বড় সুন্দর করে আশ্বাস দিচ্ছিলেন, জনগণ বেশ জমজমাট একটা খেলা দেখতে পাবে; কিন্তু তেমন কিছু ঘটেনি। কারণ যাদের সঙ্গে খেলা হবার কথা, তাড়া খেয়ে সেই দলের নেতারা মাঠে থাকবে কি, ঢুকে পড়েছে জেলখানাতে; কর্মীরা গা-ঢাকা দিয়েছে যে যেখানে পারে।
তবে নির্বাচন যেহেতু একটা খেলাই বটে, তাই প্রতিপক্ষের দরকার ছিল। ১৪ দল তো প্রতিপক্ষ নয়, সরকারি জোটেরই অংশ, তাদেরকে তাই এমনকি প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেও দাঁড় করাবার কোনো উপায় ছিল না। জাতীয় পার্টিও সরকার-আশ্রিত ‘বিরোধী দল’ বটে। তারাও তাই স্বাধীনভাবে দাঁড়াতে সাহস করেনি; সরকারের কাছ থেকে অনুমতি তথা ছাড় নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শামিল হয়েছে। তবে সুবিধা করতে পারেনি। পারবে না যে– সেটা তো জানাই ছিল। নিরুপায় হয়ে সরকার নিজের দল থেকেই একটা বিরোধী পক্ষকে নির্বাচনে দাঁড়াতে উৎসাহ দিয়েছে। দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিল কিন্তু পায়নি এমন প্রার্থীদের উৎসাহিত করেছে স্বতন্ত্র হিসেবে দাঁড়িয়ে যেতে। আগের দিন হলে এদেরকে ‘বিদ্রোহী’ বলে শনাক্ত করে শাস্তি দেওয়া হতো; এবার দেওয়া হয়েছে উৎসাহ। প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেটুকু হবার, এদের সঙ্গেই হয়েছে। ভালো সংখ্যক প্রার্থী জিতেছেও। এমনও গুঞ্জন তৈরি হয়েছিল– স্বতন্ত্ররা একাট্টা হয়ে বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হবে। তবে তেমনটা ঘটা মোটেই সম্ভব ছিল না; কারণ স্বতন্ত্ররা তো আওয়ামী লীগেরই লোক। তারা সরকারি দল ছেড়ে বিরোধী সেজে প্রত্যাশিত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে কেন? কেনইবা ঝুঁকি নেবে নিপীড়নের? ব্যতিক্রমী এমন ঘটনা ওই একবারই ঘটেছিল, যখন জাসদ গঠিত হয়; কিন্তু নদী শুকিয়ে যেতে পারে ঠিকই, তাই বলে পেছনে সরে যাবে– এটা তো স্বাভাবিক নয়। যা স্বাভাবিক তাই ঘটেছে, স্বতন্ত্ররা সরকার সমর্থকই রয়ে গেছে; বিরোধী দল গঠন করেনি।
নির্বাচন পাকিস্তানেও হয়েছে। সেখানে ইমরান খানের দল জিতবে– এমনটাই ধারণা ছিল। তারা জিতেছে বটে, তবে প্রত্যাশিত মাত্রায় নয়। কারণ সরকারের ভেতরে যে সরকার আছে পাকিস্তানে, অর্থাৎ সেনাবাহিনী; খান সাহেবকে তারা জয়ী হিসেবে দেখতে চায়নি। ইমরান খান নিজে কারাবন্দি হয়েছেন; তাঁর দলকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেওয়া হয়নি। দলের প্রার্থীরা দলীয় প্রতীক নিয়ে যে লড়বেন, তার সুযোগ ছিল না, তাঁরা ভোট চেয়েছেন বিভিন্ন প্রতীকের পক্ষে। প্রকাশ্যে চাওয়াতে বিঘ্ন ছিল, অনেকেই আত্মগোপনে থেকে প্রচার করেছেন, কেউ কেউ কারাগারে থাকা অবস্থায় ভিডিও মারফত আবেদন জানিয়েছেন। এত প্রতিবন্ধকতার মুখেও জনরায় ইমরান খানের পার্টির পক্ষেই গেছে। আমরা বাংলাদেশিরা কখনও কখনও বুক ফুলিয়ে বলে থাকি, পাকিস্তানের জন্য বাংলাদেশের কাছ থেকে শিখবার অনেক জিনিস আছে; নাকি গোপনে গোপনে শিক্ষা তারা নিচ্ছেও।
কোন কোন ক্ষেত্রে শিক্ষা নিচ্ছে, সে ব্যাপারে আমরা অবশ্য নিশ্চিত নই। তবে দেখা যাচ্ছে, একটা ব্যাপারে তারা শিক্ষা কিছুটা নিয়ে থাকবে, সেটা হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন। আমরা অবশ্য ইতোমধ্যে ‘অপরের জন্য শিক্ষণীয়’ ওই ব্যবস্থাটা পরিত্যাগ করে বেশ কিছু দূর এগিয়ে গেছি। তবে ইমরান খানের পতনের পর পাকিস্তানের যারা শাসক, তারা এক ব্যক্তিকে প্রধান করে একটি অস্থায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার বসিয়েছিল, যার অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে– এই অভিযোগ অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই উঠেছে। বিশেষ করে এই জন্য যে, এক পর্যায়ে নির্বাচনের ফল প্রকাশ থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল, এমনকি ১১ দিনেও সম্পূর্ণ ফল ঘোষণা করা যায়নি।
পাকিস্তানের রাজনীতি বিষয়ে ইমরান খান যে জ্ঞানটি সহজেই নিতে পারেন সেটা হলো, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ভয়ংকর নিষ্ঠুর ও ক্ষমতালিপ্সু একটি প্রতিষ্ঠান। ১৯৭১ সালে জুলফিকার আলি ভুট্টো মিথ্যা কথা কম বলেননি। কিন্তু অন্তত একটি মোক্ষম সত্য কথা বলেছিলেন; সেটা হলো, পাকিস্তান সেনাবাহিনী হচ্ছে একটি রাজনৈতিক দল। তিনি বলেছিলেন– পাকিস্তানে তিনটি রাজনৈতিক দল আছে, একটি তাঁর নিজের দল, অপরটি আওয়ামী লীগ এবং তৃতীয়টি সামরিক বাহিনী। যোগ করতে পারতেন এই সত্য কথাটাও যে, ওই তৃতীয়টি ছাগলের তৃতীয় সন্তান নয়, এমনকি প্রথম সন্তানও নয়; ওটিই ছাগলের আসল মালিক। ওই মালিক যে কেমন রক্তলোলুপ হতে পারে, তা একাত্তরে বাঙালিরা জেনেছিল গণহত্যার মুখে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে গিয়ে। আর ওই গণহত্যার প্রধান কর্মকর্তা ছিলেন ইমরান খানেরই আপন চাচা, সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা লে. জে. নিয়াজি। ইমরান খান যে সেই গণহত্যার নিন্দা করেছেন– এমনটা শুনিনি। চাচার গৌরবে ভাতিজা মনে হয় গর্বিতই ছিলেন; থাকাটাই স্বাভাবিক। ভাতিজা এখন টের পাচ্ছেন, ওই বাহিনী কী জিনিস।
টের অবশ্য পেয়েছেন জুলফিকার আলি ভুট্টো নিজেও, আপন প্রাণের বিনিময়ে। সামরিক বাহিনীকে গণহত্যায় তিনি উস্কানি দিয়েছেন এবং পরে ওই বাহিনীর হাতেই নিহত হয়েছেন।
জুলফিকার আলি ভুট্টো ক্ষমতায় এসেছিলেন সেনাবাহিনীর সহায়তা পেয়েই; প্রাণও দিলেন তাদের হাতে। ইমরান খান যে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন পাকিস্তানের; তার পেছনেও সেনাবাহিনীর সমর্থন ছিল। তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে ব্যর্থ হবার দরুনই প্রধানমন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন এবং এখন আটক অবস্থায় রয়েছেন, জেলখানাতে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একজন নিষ্কলঙ্ক পুরুষ– এমন দাবি সম্ভবত নিজেও করেন না। তবে পাকিস্তানের দুর্ভাগ্য এমনই, তিনি এখন ‘গণতন্ত্র উদ্ধার’-এর জন্য গঠিত সংগ্রামের নায়কে পরিণত হয়েছেন।
পাকিস্তান ভেঙে গেছে একাত্তরে এবং পাকিস্তানের বর্তমান অংশও টিকবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। সংশয় অবশ্য শুরু থেকেই ছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ও পাকিস্তানি জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃত মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ উঁচু গলায় ঘোষণা দিয়েছিলেন– পাকিস্তান টেকার জন্যই এসেছে। তবে ওই বুলন্দ আওয়াজের নীরব একটি প্রতিধ্বনি তখনই উঠেছিল– ‘পাকিস্তান কিছুতেই টিকবে না।’ প্রতিধ্বনিটিই পরে মূল ধ্বনিতে পরিণত হয়েছে।
পাকিস্তান যদি আরও ভাঙে তাহলে সেটা ঘটবে ঠিক সেই কারণেই, যে কারণে পূর্ববঙ্গ পাকিস্তান ভেঙে বের হয়ে এসেছে। সেটা হলো জাতিগত নিপীড়ন। পাকিস্তানে একটি বা দুটি নয়, জাতি ছিল পাঁচটি। এদের মধ্যে সামরিক ও প্রশাসনিকভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল পাঞ্জাবিরা। তারা তাদের কর্তৃত্ব অক্ষুণ্ন রাখতে বাঙালির ওপর গণহত্যা চালায়; সেটাই ডেকে আনে ওই পরিণতি। পাকিস্তানে এখন যা চলছে, সেটাও অন্য জাতিগুলোর ওপর পাঞ্জাবিদেরই
শাসন। পাঞ্জাবিদের সবচেয়ে সুগঠিত দল হচ্ছে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়