৫ আগস্ট বাংলাদেশে একটি ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থান শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। ওই দিন দুপুর ১২টায় শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে বোন রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন। সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যাদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটাসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরির জন্য ৫৬ শতাংশ কোটা সংরক্ষণসংক্রান্ত হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ ব্যানারে শিক্ষার্থীরা শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবির ঘোষণা দিয়েছিল ৩ আগস্ট। তার কয়েক দিন আগে শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি মেনে নেওয়ার পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য শিক্ষার্থীদের প্রবলভাবে ক্ষুব্ধ করে। তারা কতখানি ক্রোধান্বিত হলে নিজেদের ‘রাজাকার’ অভিহিত করতে দ্বিধা করে না, সেটা কি শেখ হাসিনা আদৌ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন? মেধার ভিত্তিতে সরকারি চাকরি পাওয়ার অধিকার সব শিক্ষার্থীর ন্যায্য সাংবিধানিক অধিকার, যে অধিকার ২০১৮ সালে সরকার স্বীকার করে নিয়েছিল। ২০২৪ সালের জুনে হাইকোর্টের রায়ে সে অধিকার হারাতে বসেছিল তারা। তাই আন্দোলনে তাদের চাওয়া ছিল ন্যায্য।
তাই সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঝড়ের বেগে ছড়িয়ে পড়ল কোটা সংস্কার আন্দোলন। একপর্যায়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আন্দোলনকারীদের মারধর করে রাজপথ থেকে বিতাড়নের জন্য ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, ‘ওদের হটাতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট।’ তাঁর নির্দেশ পেয়ে লাঠিসোঁটা ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ছাত্রলীগ। কিন্তু এর বিপরীতে আন্দোলনকারীরা ছাত্রলীগকে রুখে দাঁড়ায়। ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে লাশ পড়তে শুরু করে। অন্যদিকে তুমুল গতি-সঞ্চারিত হয় প্রতিরোধ সংগ্রামে, যার পরিণামে ছাত্রলীগ মার খেয়ে মাঠ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত হয় ছাত্রলীগ। এই সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে বিএনপি-জামায়াত কোটা সংস্কার আন্দোলনকে তাদের সরকার উৎখাতের এক দফার সহিংস ধ্বংসযজ্ঞে রূপান্তরিত করতে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। জ্বালাও-পোড়াও, ঢাকার বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবন ভাঙচুর, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীর রগকাটা, হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে ফেলে ছাত্রলীগ কর্মী হত্যা, দুটো মেট্রোরেল স্টেশন ধ্বংস, ইন্টারনেটের ডেটা সেন্টার ধ্বংস, সাবমেরিন কেব্ল কেটে দেওয়া, সেতু ভবন ভাঙচুর, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অফিস ভাঙচুর, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার ট্রাক পোড়ানো, রেললাইন ওপড়ানো, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর, পুলিশকে আক্রমণ এবং সর্বোপরি ৪ আগস্টে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় আক্রমণ চালিয়ে ১৩ ও নরসিংদীতে ৬ পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা, সারা দেশে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস—কোনো কিছুই আর বাকি থাকে না। আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে ৪ আগস্ট আবারও ছাত্রলীগ ও যুবলীগের মাস্তানদের আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মাঠে লেলিয়ে দেন শেখ হাসিনা। আবারও এক দিনে সারা দেশে নিহত হয় শতাধিক মানুষ। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী শাসকের পতনের উদ্দেশ্যে ‘মার্চ টু ঢাকা’র ডাক দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে লাখো মানুষ ঢাকায় পৌঁছে যায় ৪ আগস্ট রাতের মধ্যেই।
৫ আগস্ট বেলা আড়াইটায় যখন পলায়নকারী শেখ হাসিনার হেলিকপ্টারটি ঢাকা থেকে উড়াল দেয়, তখন ঢাকার উপকণ্ঠ থেকে লাখ লাখ মানুষের মিছিল রাজপথ ধরে শাহবাগ, গণভবন ও সংসদ ভবনের দিকে ধাবিত হয়।
শিক্ষার্থীদের দাবিগুলোর ন্যায্যতা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ স্বীকার করে নিয়ে রায় দিয়েছেন ২১ জুলাই। কিন্তু শেখ হাসিনার একটি বালখিল্য উক্তি কোটা সংস্কার আন্দোলনকে জামায়াত-শিবির ও বিএনপি-ছাত্রদলের সরকার উৎখাতের আন্দোলনে রূপান্তরিত করতে সহায়তা করল! ১৯ জুলাই রাত ১২টা থেকে কারফিউ জারি করে সহিংস আন্দোলন দমানোর চেষ্টা চললেও ক্রমেই আন্দোলনটি অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয়েছিল, যার পরিণতিতে প্রাণভয়ে পালাতে হলো তাঁকে। এটা অনস্বীকার্য যে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনী গণতন্ত্রকে বরবাদ করে দিয়ে শেখ হাসিনাই গণ-অভ্যুত্থানে সরকার উৎখাতকে ডেকে এনেছেন। ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনকে অসম্ভব করে দেওয়ার পরিণতি হয় গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার উৎখাত অথবা দেশে অরাজকতা ও নৈরাজ্যকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে সেনাবাহিনীর রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের বাতাবরণ সৃষ্টি হয়।
গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করেছিল। এসব সত্ত্বেও অর্থনৈতিক উন্নয়ন তাঁর একনায়কত্বকে গ্রহণযোগ্যতা দেয়নি। বলা চলে, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে গতিশীল অর্থনীতিতে পরিণত হওয়া সত্ত্বেও এই গণ-অভ্যুত্থান অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল।
শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা সশরীরে পালিয়ে যেতে পারলেও গত কুড়ি দিনের হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসযজ্ঞে চার শতাধিক মানুষের প্রাণ গেছে, শুধু ৫ আগস্টেই প্রাণ হারিয়েছেন শতাধিক মানুষ। শেখ হাসিনা কোনোমতেই এসব প্রাণহানির দায় এড়াতে পারবেন না। অর্থনীতি যে কতখানি মারাত্মকভাবে পঙ্গু হয়ে গেল, তা বুঝতে কিছুটা সময় লাগলেও দেশের অগ্রগতি যে একেবারেই থমকে গেল, সেটা এখনই বলা চলে। এখন শুরু হয়েছে আওয়ামী লীগ ও সংখ্যালঘুদের ওপর বিএনপি-জামায়াতের প্রতিশোধ গ্রহণের মহাযজ্ঞ, সেটা কত দিন ধরে চলবে—বলা মুশকিল!
৫ আগস্ট সম্পূর্ণ লুণ্ঠিত হয়েছে গণভবন, পালাতে দেরি করলে স্বয়ং শেখ হাসিনাকেই জনতা হত্যা করতে দ্বিধা করত না! সম্পূর্ণভাবে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর, একে একে লুণ্ঠিত হয়েছে সংসদ ভবন, প্রধান বিচারপতির বাসভবন, শেখ হাসিনার ধানমন্ডির বাসভবন সুধা সদন, গুলিস্তানে অবস্থিত আওয়ামী লীগের কার্যালয়, ভেঙে ফেলা হয়েছে ঢাকার বিভিন্ন জায়গার বঙ্গবন্ধুর সব ম্যুরাল ও ভাস্কর্য। তারপর বেছে বেছে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও নেতাদের বাসভবন। আক্রমণের শিকার হচ্ছে সারা দেশে আওয়ামী লীগের অফিস, নেতা-কর্মীদের বাসভবন ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, হিন্দুদের মন্দির ও বাড়িঘর। গণ-অভ্যুত্থানের শেষের দিকে বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা কোনোমতে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে পারলেও কোনো কোনো মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছেন এয়ারপোর্টে কিংবা রাস্তাঘাটে। তাঁদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোও পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে কিংবা লুটপাট ও ভাঙচুরের শিকার হচ্ছে। ঘটনাপরম্পরায় মনে হচ্ছে, এবার জামায়াত-বিএনপি চিরতরে আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করতে বদ্ধপরিকর। অন্যদিকে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা আগামীর কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশে কী চাইছেন—তা এখনো পরিষ্কার নয়।
লেখক: ড. মইনুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়