চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রীতিমতো হাট বসিয়ে নিয়োগের সওদা করেছেন সদ্য বিদায়ী উপাচার্য অধ্যাপক শিরীণ আখতার। দায়িত্বের শেষ দিনে গত মঙ্গলবার তিনি ৩৭ কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন। বরাবরের মতো এ নিয়োগেও ধার ধারেননি নিয়মনীতির। নিয়োগপ্রাপ্ত বেশির ভাগ ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ নিয়ে মেয়াদের চার বছরে ৫৪০ শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন শিরীণ আখতার, যার ১৭২ জন নিয়ে অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ রয়েছে।
চবির ইতিহাসে প্রথম নারী উপাচার্য হিসেবে ২০১৯ সালের নভেম্বরে নিয়োগ পান শিরীণ আখতার। এরপর থেকে তিনি একের পর এক অনিয়ম করে হয়েছেন বিতর্কিত। তাঁর আমলে অন্তত পাঁচটি নিয়োগ বাণিজ্যের অডিও ফাঁস হয়েছে, যেখানে ১৬ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেনের তথ্য রয়েছে। ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) খালেদ মিছবাহুল ও হিসাব নিয়ামক দপ্তরের কর্মচারী আহমদ হোসেনের কথোপকথনে স্পষ্ট, বাণিজ্যের ভাগ শিরীণ আখতারও পেয়েছেন! তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি মামলার সুপারিশ করলেও তা হতে দেননি উপাচার্য।
নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও লেনদেনের অভিযোগ এনে গত বছর মার্চে প্রশাসনিক ২২ পদ থেকে ১৯ শিক্ষক একযোগে পদত্যাগ করেন। এরপর গত ১৮ ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে টানা কর্মসূচি পালন করে শিক্ষক সমিতি। তাতেও টলানো যায়নি শিরীণের মসনদ। বরং এসব চাপ থেকে মুক্তি ও নানা অপকর্ম ঢাকতে ঢাল হিসেবে তিনি চবি ছাত্রলীগ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়োগের মাধ্যমে ‘পুনর্বাসন’ করেছেন। উপাচার্যের মেয়াদ শেষের পরদিন গত বুধবার দপ্তরে গিয়ে রেজিস্ট্রারকে শাসিয়ে আসেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। চবিতে ‘ছাত্রলীগের বাইরে কেউ চাকরি করতে পারবে না’ বলে হুমকিও দেন তারা। ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার কে এম নূর আহমদ বলেন, ‘নিয়োগের জন্য শেষ দিনে জোর করে আমার স্বাক্ষর নেওয়া হয়। তারা আমাকে হুমকিও দিয়েছে– ছাত্রলীগের বাইরে সবার নিয়োগ বাতিল করতে হবে। অন্যথায় পরিণতি খারাপ হবে।’ এ বিষয়ে সদ্য বিদায়ী উপাচার্য অধ্যাপক শিরীণ আখতারের সঙ্গে যোগাযোগ করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
তবে নবনিযুক্ত উপাচার্য অধ্যাপক আবু তাহের বলেছেন, ‘ইতোমধ্যে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে, আর ক্ষতি করা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ ও গুণগতমান নিশ্চিত করা হবে। নিয়োগে প্রাধান্য পাবে যোগ্য ও মেধাবীরা। এখন থেকে আইন মেনে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হবে।’ বিদায়ী উপাচার্যের নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অধ্যাপক শিরীণ মেয়াদকালে সিন্ডিকেটের অনুমোদনে ১৩০ শিক্ষক ও ২৩৮ কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন। কোনো বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী ১১৫ জন ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ৫৭ জন নিয়োগ দিয়েছেন। এ ১৭২ জন নিয়োগে তিনি নিয়মের ধার ধারেননি। স্বজনপ্রীতি ও আর্থিক লেনদেন করেছেন।
অনিয়মের মাধ্যমে ২০২২ সালে সাবেক সহকারী প্রক্টর অরূপ বড়ুয়ার স্ত্রীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করেন উপাচার্য। ব্যর্থ হলেও পরের বছর তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মজুরি ভিত্তিতে কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ দেন।
আবার গত বছর পরিকল্পনা কমিটির আপত্তির মুখেই আইন ও বাংলা বিভাগে শিক্ষক নিয়োগে বোর্ড ডাকেন উপাচার্য। অথচ এ দুই বিভাগের পরিকল্পনা কমিটি শিক্ষক নিয়োগের প্রয়োজন নেই বলে জানায়। গত ১৭ ডিসেম্বর আইন বিভাগের নিয়োগ বোর্ড বাতিল দাবিতে উপাচার্য কার্যালয়ে অবস্থান নেন শিক্ষকরা। পরে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে ১৮ ডিসেম্বর থেকে টানা কর্মসূচি পালন করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। আন্দোলনের মুখে বাংলা বিভাগের নিয়োগ বোর্ড স্থগিত করতে বাধ্য হন উপাচার্য। ফারসি বিভাগে শিক্ষক ও কর্মচারীর নিয়োগেও অনিয়ম করলে ২০২২ সালে নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত করে সিন্ডিকেট।
লেনদেন করতেন পিএস
উপাচার্য শিরীণ আখতারের আমলে নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ে পাঁচটি অডিও ফাঁস হয়। উপাচার্যের পিএস খালেদ মিছবাহুল ও হিসাব নিয়ামক দপ্তরের কর্মচারী আহমদ হোসেনের ফোনালাপে ছিল বড় অঙ্কের লেনদেনের ইঙ্গিত। আহমদ হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি বিভাগে শিক্ষক পদে নিয়োগ পেতে আগ্রহী এক প্রার্থীকে বলেন, ‘তৃতীয় শ্রেণির চাকরির জন্যও এখন ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা লাগে। চতুর্থ শ্রেণির জন্য ৮ লাখ। শিক্ষক হলো সর্বোচ্চ সম্মানিত পদ, ১৬ লাখের কম দিলে হবে না।’ আহমদ হোসেন আরও বলেন, ‘ম্যাডাম (উপাচার্য) যদি রাজি হন, তাহলে আপনি অর্ধেক পেমেন্ট করবেন এবং পেমেন্ট যে করছেন, সেটার একটা চেক অথবা ডকুমেন্ট দিতে হবে। কিন্তু ম্যাডাম ‘‘না’’ বললে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশেও কাজ হবে না। এটাই শেষ কথা। কারণ, ম্যাডাম নিজেও এ পদে আসছেন অনেক খরচ করে।’
উপাচার্যের পিএস খালেদ মিছবাহুল নিয়োগ প্রার্থীকে উপাচার্যের সঙ্গে আলোচনায় বসিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তিনি প্রার্থীকে বলেছিলেন, ‘চট্টগ্রামের মানুষ বলেই তোমাকে আমি টান দিলাম। উপাচার্যকে তোমার কথা বলব। তিনি যেভাবে বলবেন, সেভাবে হবে।’
জানা গেছে, অধ্যাপক শিরীণ তাঁর নিয়োগে প্রাধান্য দিতেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের। স্থানীয় বাসিন্দাদেরও রাখতেন। বিজ্ঞপ্তি ও পরীক্ষা ছাড়াই দায়িত্বের শেষ দিনে ৩৭ কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন। নিয়োগ পাওয়াদের মধ্যে ছয়জনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। তারা হলেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামিমা আক্তার, সাবেক সহসভাপতি আবু বকর, ইবনুল নেওয়াজ, সাবেক সমাজ সেবাবিষয়ক সম্পাদক ইব্রাহীম হোসেন ওরফে সাদ্দাম, ছাত্রলীগের সাবেক কর্মী নাঈম আজাদ ও বাদল কান্তি চাকমা।
ইউজিসির আদেশ উপেক্ষা
দৈনিক মজুরি কিংবা অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ বন্ধ রাখতে ২০১৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নির্দেশনা দেয় ইউজিসি। তবে এ নির্দেশনার তোয়াক্কা না করে একের পর এক দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়েছেন অধ্যাপক শিরীণ। গত তিন মাসে অন্তত ১০৫ জনকে নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। চবির নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে কয়েকবার শোকজ করেছে ইউজিসি। গত ৩ জানুয়ারিও উপাচার্যকে চিঠি পাটিয়ে ইউজিসি বাংলা ও আইন বিভাগে অনিয়মের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের উদ্যোগ স্থগিত করতে বলে। সে প্রক্রিয়া স্থগিত করলেও দৈনিক ভিত্তিতে নিয়োগ বহাল রাখেন অধ্যাপক শিরীণ।
গত বছর ফেব্রুয়ারিতে উপাচার্যের সহকারীর ফোনালাপ ফাঁসের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন নিয়োগের অনুমোদন আটকে দিয়েছিল ইউজিসি। এর পর ওই বছরের ১৭ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইউজিসিতে প্রতিবেদন পাঠায়। ওই চিঠিতে তদন্তের সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু সাবেক উপাচার্য তা পাত্তা দেননি।
রেজিস্ট্রারকে শাসাল ছাত্রলীগ
রেজিস্ট্রার কে এম নুর আহমদকে অফিস কক্ষেই শাসালেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ সময় ছাত্রলীগের এক কর্মী তাঁর সঙ্গে মারমুখী আচরণ করেন। বুধবার ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এমন ভিডিওতে দেখা যায়– শাখা ছাত্রলীগের বিজয় গ্রুপের একাংশের কর্মী ওয়াহিদুল ইসলাম রেজিস্ট্রার নুর আহমদের দিকে তেড়ে যান। এ সময় আঙুল উঁচিয়ে তিনি বলতে থাকেন, ‘ছাত্রলীগ কর্মীদের বাইরে সব নিয়োগ ক্যান্সেল করতে হবে। এখনও পেছনে বসে আছে ও। ও ছাত্রলীগ করে না। তবুও ওরে চাকরি দিয়েছেন। ওর কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা ঘুষ খাইছে ভিসি ম্যাম।’ এ সময় সহকারী প্রক্টর নাজেমুল আলম মুরাদ তাঁকে থামানোর চেষ্টা করেন।
ভিডিওতে আরও দেখা যায়, টেবিল চাপড়িয়ে একই কথা বলছেন একই গ্রুপের নেতা শাখা ছাত্রলীগের সাবেক আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক মোরশেদুল আলম রিফাত। তিনি রেজিস্ট্রারের উদ্দেশে বলতে থাকেন, ‘ছাত্রলীগের পোলারে নিয়োগ দিলে সমস্যা নাই। ছাত্রলীগের বাইরে যেগুলা, ওইগুলা ক্যান্সেল।’ জানতে চাইলে ওয়াহিদুল বলেন, ‘একাডেমিক কাজে গিয়েছিলাম, দেরি হওয়ায় রেজিস্ট্রারের সঙ্গে কথা বলেছি। হুমকির কোনো ঘটনা ঘটেনি।’
নিয়োগ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সিরাজ উদ দৌল্লাহ বলেন, ‘সদ্য বিদায়ী উপাচার্য নিজের স্বার্থে এসব নিয়োগ দিয়েছেন। এখানে আর্থিক লেনদেন আছে কিনা– তা সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা দিয়ে তদন্ত করা উচিত।’