ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধিকার-সংগ্রাম; অতঃপর উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ও সত্তরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের পথ ধরে বাঙালি পৌঁছে যায় স্বাধীনতার চূড়ান্ত মোহনায়। এরপর একাত্তরের ঐতিহাসিক সাতই মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের লাখো মানুষের উত্তাল সমাবেশে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল।
তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।…রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশা আল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর এই প্রত্যয়দীপ্ত আহ্বান পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে বিদ্যুৎ-তরঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে। তারা অসীম তেজ আর ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলে এবং স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়। প্রতিটি বাঙালি যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলার জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
এমন বাস্তবতায় পাকিস্তানি কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া ও টিক্কা খানের নেতৃত্বে বাঙালিকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে বদ্ধপরিকর হয়। আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে তারা ঢাকায় অত্যাধুনিক অস্ত্রসজ্জিত সৈন্যের সমাবেশ ঘটাতে থাকে।
সব আয়োজন শেষ করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনা অসমাপ্ত রেখে গোপনে বিশেষ বিমানে ঢাকা ত্যাগ করেন। ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে তিনি মুক্তিকামী মানুষকে হত্যার নীলনকশা হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল এ কে নিয়াজিকে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ পরিচালনার নির্দেশ দিয়ে যান। তাঁর নির্দেশ মোতাবেক ২৫ মার্চ রাত ১১টায় ঢাকা শহরে এই নিষ্ঠুর অভিযান শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, রাজারবাগ পুলিশ সদর দপ্তর, ইপিআরের প্রধান কার্যালয় পিলখানাসহ পুরান ঢাকার বিভিন্ন গলিতে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। গণহত্যার পাশাপাশি অগ্নিসংযোগ করা হয় বিভিন্ন আবাসিক এলাকায়। ভারী অস্ত্র আর প্রশিক্ষিত সেনাদের অতর্কিত আক্রমণে জনতা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি।
এ রাতেই রাজধানীর ৩২ নম্বর বাড়ি ঘেরাও করে গ্রেপ্তার করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। গ্রেপ্তারের প্রাক্কালে, অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, যা ওয়্যারলেসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে পূর্ববঙ্গসহ দেশের বাইরের বিভিন্ন স্থানে। চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ওই দিনই আওয়ামী লীগের নেতারা তা প্রচারের ব্যবস্থা করেন।
পাকিস্তানি সৈন্যরা কেবল ঢাকাতেই নয়, ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা, থানা ও গ্রাম-মহল্লায় গণহত্যা শুরু করে। তাদের সেই হত্যাযজ্ঞ কতটা নির্মম ছিল, তার কিছু চিত্র এখানে তুলে ধরার প্রয়াস চালাব উত্তরাঞ্চলের নিভৃত জনপদ পাবনায় সংঘটিত বর্বরতার বিবরণ দিয়ে।
দীর্ঘকালের সংগ্রামী ঐতিহ্যের ধারায় পাবনার মানুষ মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্যাপকভাবে সংগঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণের পর তারা বন্দুক, ছোরা, তলোয়ার, রামদা, বাঁশের লাঠিসহ দেশীয় ও আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে নানা স্থানে প্রশিক্ষণ শুরু করে। পাবনা সদর, সাঁথিয়া, বেড়া, সুজানগর, ঈশ্বরদী, আটঘরিয়া, ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর—সর্বত্রই এ চিত্র দৃশ্যমান হয়। ২৩ মার্চ পাবনা শহরে ব্যাপক গণজমায়েত, মিছিলের আয়োজন ও মহড়া দেওয়া হয়। বেলা ১১টার দিকে পাবনা টাউন হলের ছাদ থেকে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে তাতে অগ্নিসংযোগ করে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন রফিকুল ইসলাম বকুল, বেবী ইসলাম, মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু, ইকবাল হোসেন, ফজলুল হক মন্টু, শিরিন বানু মিতিল, রবিউল ইসলাম রবি, জহুরুল ইসলাম বিশুসহ অনেকে।
পাবনার মুক্তিকামী জনতাকে স্তব্ধ করে দিতে ২৫ মার্চ রাত আড়াইটায় রাজশাহী থেকে পাঞ্জাব ব্যাটালিয়নের এক কোম্পানি সৈন্য পাবনায় আসে। তারা অবস্থান নেয় পাবনা শহরের বিসিক শিল্পনগরীতে। এই সৈন্যদের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন ক্যাপ্টেন আজগর আলী। এ ছাড়া ডেপুটি কমান্ডিং অফিসার ছিলেন লে. রশিদ। তাঁদের অধীনে তিনজন সুবেদার, নায়েক সুবেদারসহ মোট সৈন্য ছিল ১৩০ জন। পাবনা শহরে কোনো বাঙালি সৈন্য বা ইপিআর ক্যাম্প না থাকায় তারা আক্রমণ চালায় নিরীহ মানুষের ওপর।
২৫ মার্চ রাতে যাঁদের হত্যা করা হয় তাঁদের একজন ছিলেন কৃষ্ণপুরের আবদুস শুকুর। রাত পেরিয়ে দিনের আলো ফুটতেই পাকিস্তানি সৈন্যরা পাবনা শহরের বিভিন্ন এলাকার দখল নিয়ে নেয়। রণসজ্জিত বেশে শহর এলাকায় টহল জোরদার করে এবং বলতে থাকে, ‘কারফিউ হো গ্যায়া, সব শালে ভাগ যাও।’ তারা নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করে অনেক সাধারণ মানুষকে। তাদের নিষ্ঠুরতা থেকে রেহাই পায়নি আগের দিন শহীদ হওয়া শুকুরের জানাজায় অংশ নেওয়া মানুষেরাও। জানাজারত অবস্থায় শহীদ হন কৃষ্ণপুরের আবদুস সামাদ। এ ছাড়া গুলিতে আহত হন শেখ বদিউজ্জামান, ছামেদ, মওলানা ইব্রাহিম খলিল প্রমুখ।
হত্যাযজ্ঞের পাশাপাশি চলে গ্রেপ্তার অভিযান। ২৬ মার্চ পাকিস্তানি সৈন্যরা পাবনা শহরের বিভিন্ন মহল্লা থেকে গ্রেপ্তার করে আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট আমিন উদ্দিন এমপিএ, ন্যাপ নেতা ডা. অমলেন্দু দাক্ষী, ব্যবসায়ী আবু সাঈদ তালুকদার, কফিল উদ্দিন আহম্মেদ, আবদুল খালেক, মোশাররফ হোসেন মোক্তার, মানসিক রোগী রাজেমসহ অনেককে। গ্রেপ্তারের সময় এসব ব্যক্তি ও তাঁদের স্বজনদের মারধর করা হয়। ডা. অমলেন্দু দাক্ষীর স্ত্রী পার্বতীচরণ দাক্ষী তাঁর স্বামীর গ্রেপ্তারের যে বিবরণ দিয়েছেন, তা শুনলে গা শিউরে ওঠে। ডা. দাক্ষী বসবাস করতেন পাবনা শহরের পাথরতলার এক চারতলা ভবনের নিচতলায়। ২৬ মার্চ রাত ৯টার দিকে পাকিস্তানি সৈন্যরা একটি জিপ নিয়ে তাঁর বাসার সামনে হাজির হয়।
লাথি মেরে দরজা খুলে চার-পাঁচজন আর্মি বলতে থাকে, ‘দাক্ষী কন হ্যায়?’ এরপর তাঁকে পেয়ে অশ্রাব্য ভাষায় বলতে থাকে, ‘শালে শুয়ারকা বাচ্চা, তুম শুনা নেহি, ম্যায় তুমকো বুলাতা হ্যায়?’ ডা. দাক্ষী তখন রাতের খাবার খাচ্ছিলেন। একজন আর্মি গিয়ে লাথি মেরে থালার ভাত ফেলে দেয়। আরেকজন সামনে থেকে সজোরে থাপ্পড় মারে তাঁর গালে। এরপর কয়েকজন আর্মি কিল, চড়, লাথি মারতে থাকে। এ সময় তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেও মারপিট অব্যাহত থাকে। চিৎকার শুনে স্ত্রী-সন্তানেরা এসে জড়িয়ে ধরেন। তখন একজন আর্মি রাইফেলের বাঁট দিয়ে আলমারির কাচ ভেঙে ফেলে। এরপর তারা অমলেন্দু দাক্ষীকে টেনেহিঁচড়ে বের করে নিয়ে যেতে থাকে।
তাঁর স্ত্রী পার্বতীচরণ দাক্ষী পেছন পেছন এগিয়ে গেলে একজন আর্মি শাড়ি ধরে টান মারে, আরেকজন তাঁকে সজোরে লাথি দিয়ে ফেলে দেয়। এরপর স্ত্রী-সন্তানদের আর্তচিৎকারের মধ্য থেকে ডা. দাক্ষীকে গ্রেপ্তার করে গাড়িতে তোলা হয়। অন্যদেরও একই কায়দায় গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতদের প্রথমে পাবনা শহরের টেলিফোন ভবনে স্থাপিত সেনাক্যাম্পে ও পরে বিসিক শিল্পনগরীর সেনাক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতনের পর গুলি করে হত্যা করা হয় আমিন উদ্দিন এমপিএ, সাঈদ তালুকদার, অমলেন্দু দাক্ষী, রাজেম আলী প্রমুখকে।
‘অপারেশন সার্চলাইট’ বাস্তবায়ন করতে আসা পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে পাবনার পুলিশ ও ছাত্র-জনতার বেশ কয়েকটি সম্মুখযুদ্ধ হয়।এর মধ্যে পুলিশ লাইনস যুদ্ধ, লস্করপুর যুদ্ধ, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ যুদ্ধ, বিসিক শিল্প এলাকার যুদ্ধ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব যুদ্ধে প্রথম পর্যায়ে আসা প্রায় সব পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন শামসুল আলম বুলবুল, ডা. আমিনুল ইসলাম বেগ, আবুল মহসিন বেগ মুকুলসহ অনেকে। টেলিফোন এক্সচেঞ্জ যুদ্ধে পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে এক বৃদ্ধের শহীদ হওয়ার ঘটনা ছিল অতিহৃদয়বিদারক।
প্রত্যক্ষদর্শী জহুরুল ইসলাম বিশু স্মৃতিচারণা করে লিখেছেন: ‘ইতিমধ্যে এক বৃদ্ধ, হাতে তাঁর দোনলা বন্দুক আর চারটি গুলি, ছুটে এসে বললেন, আর্মি দেখা যায় না? আমরা বললাম, না। তিনি দৌড়ে এগিয়ে ওই ভেন্টিলেটর দিয়ে মাথা বের করেছেন, সঙ্গে সঙ্গে একটি বুলেট এসে তাঁর কপালে লেগে মাথার প্রায় অর্ধেক উড়ে গেল। তিনি মুহূর্তে বাথরুমের মধ্যে আমাদের সামনেই পড়ে গেলেন। ওনার রক্ত ও মাথার মগজের কিছু অংশ এসে লাগল আমাদের জামাকাপড়ে। চোখের সামনে এ ধরনের দৃশ্য জীবনে প্রথম দেখে আমরা হতবাক হয়ে গেলাম।’
পাকিস্তানি সৈন্যরা এভাবেই ‘অপারেশন সার্চলাইটে’র নামে ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জনপদে নির্মম গণহত্যা চালায়। প্রথম দফায় জনতার প্রতিরোধের মুখে নিশ্চিহ্ন হলেও ১০ এপ্রিলের পর তারা প্রতিরোধব্যূহ ভেদ করে আবারও পাবনা শহরে প্রবেশ করে এবং একাত্তরের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে এবং অগণিত মানুষকে হত্যা করে নির্মমতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে। তাদের সেই নির্মমতা হালাকু খান-চেঙ্গিস খানের নিষ্ঠুরতা এবং হিটলারের বর্বরতাকেও যেন হার মানিয়েছে। তবে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর শেষ রক্ষা হয়নি।
বাংলার মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর প্রত্যক্ষ প্রতিরোধ এবং রাশিয়াসহ পৃথিবীর নানা দেশের সহযোগিতা ও মুক্তিকামী মানুষের সমর্থনে বাঙালির কাছে পরাজিত ও আত্মসমর্পণ করে এ মাটি থেকে তারা বিদায় নিয়েছে। পাকিস্তানিদের সেই নির্মমতার ক্ষত বুকে নিয়ে বাঙালি লাল-সবুজের পতাকা হাতে স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের নাগরিক হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে এগিয়ে চলেছে, আরও এগিয়ে যাবে।
লেখক: অধ্যাপক, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়