সংরক্ষণ সুবিধা না থাকায় বাংলাদেশে প্রতি বছর উৎপাদিত ফল ও কৃষিপণ্যের ৪৪ শতাংশ পর্যন্ত নষ্ট হচ্ছে, যার আর্থিক মূল্য প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলার। এসব পণ্য সংরক্ষণে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীরা দেশে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হিমাগার খাতে বিনিয়োগ করতে চায়। বাংলাদেশও যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছে।
বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বিনিয়োগ ভবনে ‘কোল্ড চেইন ইনভেস্টমেন্ট কনফারেন্স- ২০২৪’ শীর্ষক বিনিয়োগ সম্মেলনে এসব কথা জানানো হয়। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস ডিপার্টমেন্ট অফ অ্যাগ্রিকালচার-এর বাংলাদেশে ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন প্রজেক্ট (বিটিএফ) যৌথভাবে এ সম্মেলনের আয়োজন করে।
সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, ব্যাংক ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় হিমাগার খাতে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় তাদের সুদহারে ভর্তুকি দেওয়ার উপায় খুঁজছে সরকার।
তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস জানিয়েছে, দেশটির ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের বিশেষ সুযোগ তৈরি হতে পারে। বিশেষ করে চেইন কোল্ড স্টোরেজ খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী তারা। যুক্তরাষ্ট্রের এ বিনিয়োগের সুযোগ নিতে হলে তাদের সুদহারে কীভাবে ভর্তুকি দিয়ে সহযোগিতা করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা হবে। কারণ ব্যাংক ঋণের সুদহার এই মুহূর্তে বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
হিমাগার খাতে বিনিয়োগে বিশেষ সুবিধার কথা ভাবার কারণও ব্যাখ্যা করেন প্রধানমন্ত্রীর বিনিয়োগ উপদেষ্টা। তিনি বলেন, প্রতি বছর দেশে বিপুল পরিমাণ খাদ্যপণ্য নষ্ট হচ্ছে। চেইন হিমাগার তৈরি করে তা রক্ষা করা গেলে অবশ্যই রপ্তানিতে বৈচিত্র্য বাড়বে। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রতি বছর বিপুল কৃষি পণ্য নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা পাবে।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কৃষি বিনিয়োগ পরামর্শক সংস্থা লিক্সক্যাপ অ্যাডভাইজরি অ্যান্ড ক্যাপিটালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক উইলিয়াম ফেলোস। এতে তিনি বলেন, বাংলাদেশে প্রতি বছর ২০ থেকে ৪৪ শতাংশ ফল ও শাকসবজি নষ্ট হচ্ছে। এর ফলে আনুমানিক বার্ষিক ২৪০ কোটি ডলারের ক্ষতি হয়। কোল্ড চেইন লজিস্টিকসে বিনিয়োগ করলে এই ফসল-পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতি উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনতে পারবে। বাংলাদেশের আমদানি করা খাবারের ওপর নির্ভরশীলতাও কমিয়ে আসতে পারে।
উইলিয়াম ফেলোস বলেন, বাংলাদেশের পেঁয়াজ ও আলু আমদানি করতে হয়। অথচ দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজ ও আলু সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে না পারায় বিপুল পণ্য নষ্ট হয়। যদি হিমাগার ব্যবস্থাপনা উন্নত করা যেত, তাহলে বাংলাদেশের পেঁয়াজ ও আলু আমদানি করা লাগত না।
যথাযথ কোল্ড চেইন স্টোরেজ এবং অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে বিনিয়োগ আমদানি নির্ভরতা এবং ফসল-পরবর্তী ক্ষতি হ্রাস করবে জানিয়ে ফেলোস বলেন, এটি মূল্য স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করবে এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রধান খাদ্যের সরবরাহ সমতলকরণের মাধ্যমে দেশে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারে।
তিনি আরও বলেন, ২০৩১ সালের মধ্যে এই পরিষেবায় ৪৪ কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ হতে পারে। কৃষি খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লজিস্টিক ব্যবসা হিসেবে পরিবহন, গ্রেডিং, লেবেল এবং প্যাকেজিংয়ের মতো পরিষেবার শিল্পও গড়ে উঠবে।
ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের কৃষি সার্ভিস অ্যাটাশে সারাহ গিলেস্কি বলেন, বাংলাদেশে একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি হয়েছে। এর ফলে এখানে বিশেষ করে খাদ্য পণ্যের বিশাল বাজার তৈরি হয়েছে। এই বাজার ধরার জন্য এ খাতে বিনিয়োগের একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। এ খাতে বিনিয়োগের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সরকারি সহযোগিতা দরকার। বাংলাদেশকে প্রতিযোগী দেশগুলোর মত বা অনেক ক্ষেত্রে অন্য দেশের তুলনায় বেশি সুবিধা দিতে হবে। তাহলে খুব দ্রুত বিনিয়োগ আসবে।
অনুষ্ঠানে পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ বলেন, বাংলাদেশে এখনও মোট রপ্তানির ৮৪ শতাংশই পোশাক খাত। দেশের রপ্তানি খাতে বৈচিত্র্য আনতে কৃষি খাত বিশাল অবদান রাখতে পারে। কৃষির অপার সম্ভাবনা কাজে লাগাতে গেলে অবশ্যই জমি ব্যবহারের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে সেই অনুযায়ী উৎপাদন ও শিল্পায়ন বাড়াতে হবে।
তিনি বলেন, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির জন্য আমদানি শুল্ক কমানো দরকার। ভিয়েতনামের তুলনায় বাংলাদেশে দেশে তিন গুণ শুল্ক নেওয়া হয়। এতে বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হবেন।
সম্মেলনে সভাপতির বক্তব্যে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিয়া বলেন, কৃষি ক্ষেত্রের সক্ষমতা বেড়েছে। কৃষি পণ্যের উৎপাদন বেড়েছে কয়েক গুণ। কিন্তু এগুলো পচনশীল দ্রব্য হওয়ায় যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে রপ্তানীর পরিবর্তে উল্টো আমদানি করতে হয়। এক্ষেত্রে কোল্ড চেইন বিনিয়োগ হবে অত্যন্ত লাভজনক বিনিয়োগ।
এ সময়ে তিনি বলেন, বিভিন্ন বিনিয়োগ প্রতিবন্ধকতা দূর করাসহ বিনিয়োগকারীদের সব ধরনের বিনিয়োগ সেবা প্রদান করবে বিডা।