ঢাকার স্বনামধন্য স্কুলে পড়তাম। এসএসসির আগে নির্বাচনী পরীক্ষা হতো, যাকে আমরা টেস্ট পরীক্ষা বলতাম। সেই টেস্ট পরীক্ষায় পদার্থ বিজ্ঞানের পেলাম ৩৮। বোর্ডে ৩৩-এ পাস হলেও স্কুলে পাসের নম্বর ছিল ৪০।
একটা সময় পর্যন্ত বরাবর ফার্স্ট-সেকেন্ড হওয়া আমি ফেল করলাম। এটা ছিল বিরাট আহত হওয়ার মতো ঘটনা। আমার মা’কে ডেকে পাঠালেন শিক্ষক। বললেন তার কাছে কোচিং না করলে এসএসসিতে পাস করতে পারবো না আমি।
সবাই পাস করেছিল কেবল আমি ফেল এইজন্যই যে, একমাত্র আমি ঐ শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়তাম না। ফলাফল আমি ফেল। এই ঘটনা এখনো আমার মনে আছে। ফেল করা ছাত্রীর যে মানসিক কষ্ট আর হীনমন্যতা তৈরি হয় সেই শাস্তি আমাকে দেওয়া হয়েছিল কোনো অপরাধ ছাড়াই।
কেবল ২ নম্বরের জন্য ফেল করেছি তাতেই মনোজগতের যে পরিবর্তন হয়েছিল আমার, তা অবর্ণনীয়। আচ্ছা, যে শিক্ষক ছাত্রীর গায়ে হাত দেয় বা ছাত্রীকে খারাপ প্রস্তাব দেয় সেই মেয়েটির তখন কেমন লাগে? তার কেমন বোধ হয়? আপনারা কেউ কি ভাবতে পারছেন?
শিক্ষকের চিরচেনা চেহারাটা কি তার সামনে অদৃশ্য হয়ে যায়? সেকি সেইখানে চলতি পথের একজন ধর্ষককে দেখতে পায় যে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝাঁপিয়ে পড়বে? সে কি দেখতে পায় শিক্ষকের চেহারার আড়ালে থাকা পিশাচের মুখ?
সেই শিক্ষকই যখন পরদিন শার্ট প্যান্ট পরা ভদ্রলোক, নীতিকথা আর নানা বিষয়ে জ্ঞানের কথা বলে তখন কেমন লাগে সেই ছাত্রীর? কেমন লাগে যখন বছরের পর বছর সেই দায় টেনে বেড়াতে হয় ছাত্রীদের, যখন একা হয়ে যেত হয় সবার কাছ থেকে
যখন পড়াটাও শেষ করা যায় না শিক্ষকের জন্য, কেমন লাগে? তা মরে যাওয়ার আগে বলে গেছে ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকা। অবন্তিকার পোস্ট থেকে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম ও আইন বিভাগের শিক্ষার্থী আম্মান সিদ্দিকী তার জীবন অতীষ্ট করে তুলেছিল। কেউ কি শুনেছে সেই অভিযোগ?
অবন্তিকার মৃত্যুর পরদিন আমরা জানি আরও ভয়াবহ ঘটনা। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের কাজী ফারজানা মীম। সে জানিয়েছে তার কেমন লেগেছে। তার ভাষ্যমতে, একাডেমিক কাজে ২০১৯ সালের নভেম্বরে তাকে ডাকে কোর্সশিক্ষক আবু শাহেদ ইমন।
মীমের অভিযোগ, সেইখানে যৌন হয়রানির চেষ্টা করা হয়। এরপর কেটেছে ৫ বছর। সেই শিক্ষক বহাল তবিয়তে আছে। কিন্তু মেয়েটির জীবন তো শেষ। অনার্সে তাকে ফেল করানো হয়েছে। এক বিষয়ে সেই পেয়েছে ডাবল শূন্য। কোনো অনার্সে পড়া ছাত্রীর পক্ষে সাদা খাতা জমা দেওয়া ছাড়া কিছুতেই শূন্য পাওয়া সম্ভব নয়। কিছুতেই না। মেয়েটি পেয়েছে এবং স্নাতকে ফেল করেছে।
বাবা-মা তার কত কষ্টের টাকা শেষ করে প্রতিদিন সন্তানের পড়াশোনার খরচ জোগাড় করেন তা কি এই শিক্ষকরা জানে? জানতে চাই? কী অসম্ভব নির্মমতার খবর এটি যে, শিক্ষকের অনৈতিক প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় একজনের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কেউ তো তবু এই অনাচারের কথা বলছে। বেশিরভাগই বলে না।
সব শিক্ষকই আমাদের কাছে দারুণ শ্রদ্ধার। কিন্তু আজকাল শিক্ষক নামধারী মানুষগুলো কেউ কেউ ভয়ংকর হয়ে উঠছে। তাদের লোভ তারই ছাত্রীর দিকে, যাকে মা-বাবা তার কাছে পাঠিয়েছে নিরাপদ আশ্রয় ভেবে। বাড়ির বাইরে স্কুল-কলেজকেই সবচেয়ে নিরাপদ ভাবেন অভিভাবকরা।
অথচ আজকাল কি শুনছি আমরা? ভিকারুননিসা মতো স্কুলের শিক্ষক মুরাদ হোসেন মেয়েদের কোচিং-এর নামে যা করছে, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রিন্সিপাল ফৌজিয়া রাশেদী যখন তার ৬৫ বছরের বন্ধু খন্দকার মুশতাক আহমেদের জন্য১৮ বছরের শিক্ষার্ী সিনথিয়া ইসলাম তিশাকে প্রলুব্ধ করে তখন মনে হয় আমরা আসলে আছি কোথায়?
এরচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটে মাদ্রাসায়। কখনো মেয়ে শিক্ষার্থী, কখনো ছেলে শিক্ষার্থীর ধর্ষণ বা বলাৎকারের ঘটনা ঘটছে অহরহ। সব কি গণমাধ্যমে আসে? এইসব দেখে আমি ভাবি আমরা কাদের হাতে ছেলেমেয়ের তুলে দিচ্ছি? শিক্ষক নামধারী এরা কারা?
এরা কারা একটু পেছনের খবর যখন নেওয়ার চেষ্টা করছি দেখেছি, এরা বেশিরভাগই প্রভাবশালী অথবা প্রভাবশালীদের ছায়াতলে থাকা লোকজন। রাজনৈতিকভাবেই কেবল নয় আর্থিক বা সামাজিকভাবেও এরা প্রভাবশালী। তাদের নিয়োগও হয় কারও না কারও সুপারিশে।
এইসব প্রভাবেই তারা এমন অপকর্ম করে। তারা জানে, এইসব খবর জানাজানি হলেও পার পেয়ে যাবে ঠিকই। হয়ও তা। এইসব শিক্ষকের রক্ষাকর্তা হিসেবে দাঁড়িয়ে যায় ঐ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরই কেউ না কেউ, তার সহকর্মী অন্য শিক্ষক, বিভাগের প্রধান, প্রিন্সিপাল বা উপাচার্য পর্যন্ত।
এদের রুখবে কে? এতসব ঘটনার পর আপনি কি পারবেন খুব নিশ্চিন্তে মেয়েকে বিদ্যালয় বা মাদ্রাসায় পাঠাতে? পারবেন তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য ছেড়ে দিতে যাতে সে আত্মবিশ্বাসী হয়ে গড়ে ওঠে?
পারবেন না, কারণ এদের কারও বিচার হয় না। বিচারের সংস্কৃতি বহু আগেই নষ্ট হয়ে গেছে। এরা পার পেয়ে আবার শুরু করে, শিকারির মতো শিকার খোঁজে। সেই অভয়ারণ্যে এরা টিকে থাকে সাহসের সাথে, এরা বেঁচেও থাকে, মরে যায় শুরু অবন্তিকারা। শারীরিক না হয় মানসিকভাবে।
নাজনীন মুন্নী ।। সাংবাদিক