Saturday, April 27, 2024
spot_img
Homeমতামতআমাদের সংগ্রাম চলবেই

আমাদের সংগ্রাম চলবেই

৬ ডিসেম্বর ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, সেদিন থেকেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নামও বদলে যায়। নতুন নাম দাঁড়ায় বাংলাদেশ বেতার; অর্থাৎ সেদিন থেকেই এটি পুরোপুরি একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো। বিপ্লবী তো নয়ই, বিদ্রোহী চরিত্রটাও আর অবশিষ্ট রইল না।

আধুনিক যুগে বেতার যে কত শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ এর প্রমাণ একাত্তরে পাওয়া গেছে। হানাদারদের আচমকা আক্রমণে মানুষ যখন দিশেহারা, তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র যে ভূমিকা পালন করেছিল, সেটা কোনো দিক দিয়েই সামান্য নয়। বেতার ছিল অন্ধকার ভেদ করে ফুটে-ওঠা একটা আশার আলো। বোঝা গিয়েছিল সবকিছু হারিয়ে যায়নি, প্রতিরোধ তৈরি হচ্ছে। দেশের ভেতরে কোথায় কী ঘটছে তার একটা ধারণা পাওয়া গেল। বিশ্বে খবর ছড়িয়ে পড়ল যে ভিন্ন স্বর শোনা গেছে। স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। যুদ্ধ চলছে। প্রবাসী সরকারের নির্দেশ পৌঁছে যাওয়া শুরু করল মানুষের কাছে। পাকিস্তান সরকার তাদের বেতারে দিনরাত যেসব মিথ্যা কথার প্রচার চালাচ্ছিল, তার জবাবও আসছিল এই বেতার কেন্দ্র থেকে। বেতার কেন্দ্রটিকে হানাদারেরাও কম গুরুত্ব দেয়নি। প্রথমে তারা প্রচার করেছিল হুগলি নদীর মোহনায় একটি জাহাজ থেকে বেতারের আওয়াজ ছড়ানো হচ্ছে; সবটাই ভারতীয় ষড়যন্ত্র। কিন্তু সেই প্রচারে তাদের নিজেদেরও আস্থা ছিল না; তারা অকুস্থল খুঁজে বের করেছিল এবং বোমারু বিমান পাঠিয়েছিল বেতার কেন্দ্রটিকে ধ্বংস করার জন্য। এ কাজটিকে তারা তখন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। বস্তুত কালুরঘাট ট্রান্সমিটার কেন্দ্রের ওপর দশ মিনিট ধরে একটানা বোমাবর্ষণ ছিল বাংলাদেশে তাদের প্রথম বিমান হামলা। প্রচার কেন্দ্রটিকে অচল না করা পর্যন্ত স্বস্তি পায়নি।

কিন্তু যে বিপ্লবী সম্ভাবনা নিয়ে বেতার কেন্দ্রটি আত্মপ্রকাশ করেছিল, তা টেকেনি। রাজনৈতিক জনযুদ্ধটি তার বৈপ্লবিক চরিত্র সূচনাতেই হারিয়ে ফেলেছিল। নাম থেকে বিপ্লবী অভিধার প্রস্থান কোনো দুর্ঘটনা ছিল না, এটিই ছিল স্বাভাবিক; জাতীয়তাবাদী লড়াইটা সমাজতান্ত্রিক লড়াইয়ে পরিণত হোক—এমনটা প্রভাবশালী দুটি মহলের কোনোটিই চায়নি। রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সামরিক নেতৃত্ব—এই দুই মহলের মধ্যে একধরনের দ্বন্দ্ব ছিল এটা ঠিক; সামরিক নেতৃত্বের কোনো কোনো অংশ এমনও চিন্তা করেছে যে যুদ্ধের নেতৃত্ব একচ্ছত্ররূপে আওয়ামী লীগের হাতে থাকা উচিত নয়, কারও কারও এমনও ইচ্ছা ছিল যে যুদ্ধ শেষ হলে ক্ষমতা চলে যাবে সামরিক বাহিনীর হাতে, তারা নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে, করে ক্ষমতা তুলে দেবে নির্বাচিতদের হাতে। কিন্তু সামরিক-বেসামরিক সব পক্ষই এক মত ছিল সামাজিক বিপ্লবের বিরোধিতার ব্যাপারে। যুদ্ধের সময়ে সামরিক আমলাতন্ত্রের কর্তৃত্বপরায়ণতা প্রকাশিত হয়েছে। পরে স্বাধীন বাংলাদেশে তারা ভয়াবহ সব হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। নিজেরাও নিহত হয়েছে। ওদিকে যে জাতীয়তাবাদী শক্তি যুদ্ধকালে নেতৃত্বে ছিল এবং পরে যারা রাষ্ট্রক্ষমতা করায়ত্ত করেছে, তাদের নিজেদের ভেতর বিরোধ ছিল অমীমাংসেয়, যে জন্য তারা পারস্পরিক শত্রুতাতে লিপ্ত হয়েছে। কিন্তু তাদের প্রধান শত্রু ছিল জনগণের বিপ্লবী চেতনা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে বিপ্লবী নাম দেওয়াটাও কিন্তু কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার ছিল না, স্বাধীনতা মানুষ আগেও একবার পেয়েছিল, সেই স্বাধীনতা ছিল শুধু নামেরই, দেশের বেশির ভাগ মানুষের জন্য তা কিছুই বহন করে আনতে পারেনি, দুর্ভোগ ভিন্ন। জনগণের উপলব্ধিতে একাত্তরের যুদ্ধ তাই শাসকবদলের ছিল না, ছিল সমাজবদলের; অর্থাৎ বিপ্লবের। বেতারকর্মীদের অগ্রসর অংশ সেই উপলব্ধিকেই ধারণ করতেন। যুদ্ধ জনগণই করেছে; কলকাতায় যাঁরা চলে গিয়েছিলেন, কিংবা বাধ্য হয়েছিলেন শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় নিতে, তাঁরা কিন্তু যুদ্ধ করেননি, অধিকাংশই সময় কাটিয়েছেন হানাদারদের বর্বরতা এবং নিজেদের দুর্ভাগ্যকে অভিলাষ দিয়ে; কিছু ছিলেন যাঁরা সুবিধা ভোগ করেছেন এবং হতাশায় ভুগেছেন। যুদ্ধের পরে সুবিধা যা হওয়ার ছিল, সেগুলো মূলত তাঁদেরই করতলগত হয়েছে।

৬ ডিসেম্বর ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, সেদিন থেকেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নামও বদলে যায়। নতুন নাম দাঁড়ায় বাংলাদেশ বেতার; অর্থাৎ সেদিন থেকেই এটি পুরোপুরি একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো। বিপ্লবী তো নয়ই, বিদ্রোহী চরিত্রটাও আর অবশিষ্ট রইল না। বেতারের নিয়মিত কর্মীরা আগেই সরকারি কর্মচারী হয়ে গিয়েছিলেন, এখন পুরোপুরি বেতনভুক হয়ে পড়লেন। দেশে ফেরার পর পোস্টিং, প্রমোশন, ট্রান্সফার—এসব বিষয় সামনে চলে এল। মুজিবনগরী হাজি এবং দেশীয় অ-হাজিদের ভেতর পার্থক্য দেখা দিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরে তো বেতারের নামই বদল করে দেওয়া হয়েছিল। নতুন নাম হয়েছিল রেডিও বাংলাদেশ; পাকিস্তানি স্টাইলে। সেই নাম অবশ্য টেকেনি। তবে রাষ্ট্রীয় বেতার ক্রমেই তার গুরুত্ব হারিয়েছে। একের পর এক প্রাইভেট এফএম রেডিও চলে এসেছে। রাষ্ট্রীয় বেতার জনগণের থাকেনি, মুখপত্র হয়েছে সরকারের। বারবার সরকার এসেছে এবং চলে গেছে, কিন্তু কোনো সরকারই জনগণের পক্ষের শক্তি হয়নি। বেতারও আর জনগণের মিত্র থাকেনি, একাত্তরের যুদ্ধের সময়ে যেমনটা ছিল। চরিত্রে ‘বৈপ্লবিক’ পরিবর্তন ঘটে গেছে।

যুদ্ধের সময় এটা অস্পষ্ট ছিল না যে ভারতের রাজনৈতিক আগ্রহটা কেবল শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোতে সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল ঘোষিত শত্রু পাকিস্তানকে ভাঙা পর্যন্ত। সাময়িক বিবেচনার বাইরে, তাদের স্থায়ী ইচ্ছাটা ছিল পাকিস্তানকে ভাঙারই। ভারতের জন্য যা ছিল শত্রুকে পর্যুদস্ত করা, আমাদের জন্য সেটাই দাঁড়িয়েছিল স্বাধীনতা। একযাত্রায় পৃথক ফল। ১৬ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়কের অনুপস্থিতিটা লক্ষ করার মতো ঘটনা বৈকি। তার প্রতীকী মূল্যও কম নয়।

পাকিস্তানের পতনের পর বাংলাদেশকে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার জন্য ভারতীয় আমলারা এসেছিলেন, বেতারে এসেছিলেন একজন পরামর্শক। তাঁরা অবশ্য চলে গেছেন। কিন্তু অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ভারতের প্রভাব কমেনি, দিনে দিনে বরং বেড়েছে। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার যদি বিপ্লবী হতো, তাহলে নেতাদের কাজটাও হতো ভিন্ন রকমের। বিপ্লবের সম্ভাবনার ভেতরে যেমন প্রতিশ্রুতি ছিল মৌলিক পরিবর্তনের, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক মুনাফালোলুপতার তথা শোষণের পরিবর্তে মানবিক করার, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভেতরও তেমনি সম্ভাবনা ছিল বেতারকে কেবল পাকিস্তানিদের হটিয়ে দেওয়ার জন্য নয়, দেশপ্রেমকে উচ্চতর স্তরে নিয়ে গিয়ে দেশবাসীর ভেতর সর্বক্ষেত্রে নতুন সৃষ্টিশীলতাকে উৎসাহিত করার; বিশেষ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে তো খুব বড় রকমের পরিবর্তন আনার জন্য কাজ করতে পারত ওই বেতার কেন্দ্র। পরে টেলিভিশন এসেছে। টেলিভিশনও পারত রেডিওর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে, রেডিও যদি দৃষ্টান্ত স্থাপন করত। কিন্তু রেডিওর বিপ্লবী সম্ভাবনা তো নিঃশেষ হয়ে গেছে সূচনাতেই। আড়াই দিনের মাথায়, মার্চ মাসের ২৮ তারিখেই, যেদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বিপ্লবী শব্দটাকে নামিয়ে ফেলা হয়। ওটি তো কেবল একটি শব্দ ছিল না, ছিল একটি স্বপ্ন, সমষ্টিগত স্বপ্ন।

স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। পাকিস্তানি রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পার্থক্য বিস্তর, কিন্তু মিল নেই এমনটা বলার উপায় নেই। মিলগুলো ক্রমাগত উন্মোচিত হচ্ছে। ধরা যাক গণধর্ষণের ব্যাপারটা। ওই কাজ পাকিস্তানি হানাদারেরা একাত্তরে করেছে। ক্ষমতার জোরে, এখন বাঙালি দুর্বৃত্তরা করছে। ক্ষমতা আছে বলেই করতে পারছে। পাকিস্তানি আদর্শ ফেরত এসেছে যাঁরা বলছেন, তাঁরা ভুল বলছেন। ওই আদর্শ যে বিদায় নিয়েছিল তা তো নয়। আদর্শ হস্তান্তরিত হয়েছিল মাত্র, পাকিস্তানি শাসকদের হাত থেকে চলে এসেছিল বাঙালি শাসকদের হাতে। হয়তো বলা যাবে যে পাকিস্তানি শাসকেরা ছিলেন অবৈধ, আর বাঙালি শাসকেরা বৈধ। কিন্তু সব বাঙালি শাসকই কি বৈধ? সামরিক শাসন কি আসেনি? প্রহসনমূলক বৈধ নির্বাচন কি ঘটেনি?

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে একটি গান শোনানো হতো। সেটির শিরোনাম ছিল ‘আমাদের সংগ্রাম চলবেই’। সংগ্রাম সেদিন চলেছিল, আজও চলেছে। ভরসা আসলে সেটাই। বেলাল মোহাম্মদ স্মরণ করেছেন যে ভারতীয় অফিসাররা তাঁদের বলতেন, ‘তোমাদের ওখানে তো দেখছি অনেক উন্নতি হয়েছে, তোমরা খামোখা গোলমালের মধ্যে গেলে কেন?’ তাঁরা খেয়াল করেননি যে উন্নতির রূপকথার ভেতর একটা দৈত্যও ছিল, রূপকথার ভেতর দৈত্যরা সাধারণত থাকেই। সেই দৈত্যটার নাম বৈষম্য। বাঙালিরা সেদিন ওই দৈত্যটার বিরুদ্ধেই লড়ছিল। সে সময়ে ওই দৈত্যটা ছিল আঞ্চলিক বৈষম্যের, এখন দাঁড়িয়েছে শ্রেণিবৈষম্যের। শ্রেণিবৈষম্য সেদিনও ছিল, কিন্তু সেটা চাপা পড়ে গিয়েছিল পূর্ব-পশ্চিমের বৈষম্যের নিচে; বাঙালি অর্থনীতিবিদেরা যার সময়োপযোগী নাম দিয়েছিলেন দুই অর্থনীতি। এখন এক অর্থনীতির ভেতর পরিষ্কারভাবে দেখা দিয়েছে দুই শ্রেণি—ধনী ও দরিদ্র। এখনকার সংগ্রামটা তার বিরুদ্ধেই। এই সংগ্রাম চলছে, চলবে। দেশপ্রেমিকেরা লড়বে।

লেখক: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

RELATED ARTICLES

Leave a reply

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments