Thursday, May 9, 2024
spot_img
Homeমতামতআমরা কোথায় যাচ্ছি, কে তা জানে!

আমরা কোথায় যাচ্ছি, কে তা জানে!

এমন কিছু বিষয় কয়েক বছর ধরে ঘটে যাচ্ছে, যার নাগাল পাওয়া কঠিন। ‘ভিউ’ নামে পুরোনো একটি শব্দ নতুন করে ইউটিউব, ফেসবুকসহ নানা মাধ্যমে এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, যা অকল্পনীয়। যার সঙ্গে সরাসরি যোগ আছে ডলারের। দেশের মানুষ যখন বহুদিন ৮৫ টাকায় স্থির হয়ে থাকা ডলারের দাম ১২৫ টাকা অবধি উঠতে দেখেছে, তখন এই ইউটিউব এবং ফেসবুকে ‘কনটেন্ট’ দিয়ে চার-ছক্কা মেরে চলেছেন অনেকেই। স্রোতের মতো তাদের পকেটে টাকা ঢুকছে। যে কেউ আজ শিল্পী হতে পারেন। যেকোনো কনটেন্টই হতে পারে ভাইরাল। ভাইরাল হওয়ার জন্য যেন খেপে উঠেছে সবাই। ব্যাপারটা কী?

২. আমাদের চোখের সামনে দিয়ে গণমাধ্যমের চেহারা বদলে গেল। আমরা যারা একটি মাত্র টিভি সেন্টার এবং কালো রঙের একটি টেলিফোন সেট নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলাম, তারা তখন এফএম ব্যান্ড বলে কোনো কিছুর খবরও জানতাম না। আমাদের শৈশবে সংবাদপত্রের ফিচার বিভাগগুলো সংহত ছিল না। ফিচার ছিল, কিন্তু তা এতটা বর্ণাঢ্য ছিল না।

আমরা হাতে কম্পোজ করা ছাপাখানার সঙ্গে পরিচিত ছিলাম। এরপর লাইনো, অফসেটসহ কত ধরনের ছাপাখানাই না এসেছে। আমরা কম্পিউটারে লিখে ট্রেসিং বের করার সময়টাতেও সাংবাদিকতা করেছি। এরপর তা আরও কত দূর অগ্রসর হয়েছে!

বাংলাদেশ টেলিভিশনের পর স্যাটেলাইট টেলিভিশন যখন এল, তখন বদলে গেল টেলিভিশনের অনুষ্ঠান ও সংবাদের চেহারা; বিশেষ করে একুশে টেলিভিশন নতুন টিভি সাংবাদিকতার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। আমরা এখন যে সময়টিতে বসবাস করছি, সে সময়টি অন্য যেকোনো সময় থেকে একেবারে আলাদা। পৃথিবীতে বিবর্তন ও বিপ্লবের মাধ্যমে বহু পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু এখন এত দ্রুত সব পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে যে কিছুদিন আগে কোন বিষয় নিয়ে মাতামাতি করেছে মানুষ, সেটাই ভুলে যাছে। একের পর এক নতুন কিছুর উদ্ভব পুরোনোকে নিয়ে থাকতে দিচ্ছে না। একটি ছোট্ট মোবাইল ফোনে পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষের জীবন আটকে গেছে।

৩. একটি মোবাইল ফোনের মধ্যে জীবনের চাহিদা মেটানোর মতো সবকিছুই পাওয়া যাচ্ছে। আরও ভালো করে বললে, সেখানে বিনোদনের ডালি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সূক্ষ্ম ও স্থূল নানা কিছুর সন্ধান পাওয়া যায় নেটসংযোগ থাকলেই। এই সত্যের মুখোমুখি হয়েই পরবর্তী কথাগুলো বলতে হবে।

বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে যে কেউ এখন স্রষ্টা হয়ে উঠতে পারে। ব্যাখ্যা করি। ছিল একটা সময়, যখন আমরা ছিলাম শুধুই শ্রোতা, দর্শক অথবা পাঠক। শিল্প বা সাহিত্য যাঁরা তৈরি করতেন, তাঁদের দেখতাম মুগ্ধ নয়নে। চলচ্চিত্র জগৎ ছিল মায়ার জগৎ। চলচ্চিত্রের মানুষেরা যেন স্বপ্নের জগৎ থেকে উঠে এসে আমাদের বাস্তব জগতে কিছুকাল বিচরণ করে বেড়াতেন! কবিদের দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকত ভক্তরা। কেউ কবিতা লিখছে, তা যেন ঈশ্বর-প্রদত্ত কোনো বিষয়।

এবার যে কথাগুলো বলব, তা কোনো উচ্চমার্গীয় ব্যাপার নয়। কিন্তু প্রসঙ্গটি আমাদের আলোচনার সঙ্গে যুক্ত বলে তা নিয়ে একটু কথা বলতে চাই। অনেকেই আধুনিক শিল্পকলা বিমূর্ত হয়ে উঠেছে বলে শিল্পীদের দোষারোপ করে থাকেন। শুধু কি তা-ই? আধুনিক কবিতাও দুর্বোধ্য। আধুনিক নাটকের নাগালই বা পায় কজন?

কেন নাগাল পায় না? কারণ শিল্পীর মনের ভেতর যে আলোড়ন, সেই আলোড়নের সঙ্গে শ্রোতা-দর্শকের অভিজ্ঞতার দূরত্ব বেড়েছে। অভিজ্ঞতার মিল না থাকলে বিষয়বস্তুর সঙ্গে নিজের সম্পর্ক আবিষ্কার করা কষ্টকর। যা অভিজ্ঞতায় নেই, তার রস খুঁজে পাওয়া কঠিন। এ কারণেই আধুনিক শিল্পকলা কিন্তু অজনপ্রিয়।

একটা সময় ছিল, যখন শিল্পী যা বলছেন, যা করছেন, তা সাধারণ জনগণ বুঝতে পারত। কিন্তু আধুনিক কালে (আমি আধুনিক কাল থেকে শুরু করে পরবর্তীকালে জন্ম নেওয়া নানা ‘ইজম’ নিয়ে কথা বলছি) দেখা গেল, শিল্পীর বোধের জগৎটি ধীরে ধীরে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বোধের জগতের সঙ্গে একটা দূরত্বের সৃষ্টি করেছে। শিল্পী বললেন, আমার কাছে আসতে হলে আমার ভেতরে যে ঘটনা-দুর্ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাত চলছে, তা পার হয়েই আসতে হবে। নইলে আমি বলে বলে বোঝাব না, আমি কী বলতে চাইছি।

শিল্পীর বোধের নাগাল না পাওয়ায় বেশির ভাগ মানুষই আর শিল্পকলার কাছাকাছি হতে পারল না। ফলে শিল্পীর কাজ বুঝে না বুঝে দেখে গেছে আমজনতা। শিল্পীও এই দূরত্ব ঘোচানোর খুব একটা চেষ্টা করেননি। আর সাম্যবাদের প্রবক্তাদের কেউ কেউ শিল্পকে সহজ করতে গিয়ে এতটাই জোলো করে তুলেছিলেন যে সেই ভাষায় আর যা-ই থাকুক শিল্প ছিল না। তবে হ্যাঁ, মানবিকতার একটা মানে ছিল। নৈতিকতার একটা রূপ ছিল সে সময়েও।

৪. সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় ওঠাকে যিনি গুরুত্ব দেন না, তিনি বোকার স্বর্গে বাস করেন। এখন বিভিন্ন কারণেই পত্রিকা কিংবা বেতার-টেলিভিশনের সংবাদের ওপর মানুষের আস্থা কমে গেছে। নতুন কোনো সোর্স থেকে সংবাদ সংগ্রহ করতে ভালোবাসে নতুন যুগের মানুষ। নির্দিষ্ট সময়ে খবর শোনার জন্য টেলিভিশনের সামনে কজন হাজির হয়? বরং আঙুলের চাপে নেটের দুনিয়ায় ‘লিংক’ দেখেই খবরাখবর সংগ্রহ করে নেয় মানুষ। আর বিনোদন? এখন যিনি শ্রোতা, তিনিই শিল্পী।

‘সেলিব্রিটি’ শব্দটা যে অর্থে ব্যবহার করা হতো, আজ তার ব্যাপ্তি বেড়েছে। কণ্ঠে সুর থাকুক আর না-ই থাকুক, গান গেয়ে তা মানুষের মাঝে ছেড়ে দেওয়া যায়। সুর-তাল-লয় থাকছে না, কিন্তু তা নিয়ে কথা বলা যাবে না। বেসুরো রবীন্দ্রসংগীত গাইলে তা নিয়ে প্রতিবাদ করা যাবে না। প্রতিবাদ করলে ‘জনগণের সংস্কৃতি’র মাহাত্ম্য বর্ণনা করে ছেয়ে যাবে ফেসবুক। সংগীতটা যে চর্চার বিষয়, সেটা মনে করিয়ে দিলে বলা হবে, রুচি নিয়ে প্রশ্ন তোলার অধিকার কারও নেই।

শুধু কি তা-ই? টাকা থাকলে প্রতিষ্ঠানপ্রধান দেশের নায়ক-নায়িকা, সাংবাদিকদের জড়ো করে নিজের মাহাত্ম্য কীর্তন করাবেন এবং বেসুরো গানকেই সেরা গান হিসেবে মত দিয়ে যাবেন। এই সব বিষয়কে একজন শিল্পী ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ বলায় তাঁর ওপর খেপেছিলেন অনেকেই, তাঁদের মধ্যে সমাজের ‘বিশিষ্টজনেরা’ও আছেন।

৫. কিছুদিন আগে বইমেলায় বেশ কিছু অদ্ভুত কাণ্ড ঘটল। প্রতারণার দায়ে জেলখাটা এক চিকিৎসক (তিনি নারী) হঠাৎ করে লিখে বসলেন জেলজীবন নিয়ে এক বই। এক বৃদ্ধ এক তরুণীকে বিয়ে করে বারবার ফেসবুকে আসতে লাগলেন। বয়সের ব্যবধান সত্ত্বেও তাঁরা কত সুখী, সেটা প্রমাণ করতে চাইলেন এবং ভাইরাল হলেন।

কুড়ি বছর আগে হলে এ ধরনের ঘটনা থেকে যেত লোকচক্ষুর আড়ালে। কিন্তু এখন ভাইরাল হওয়ার মওকা আছে। ভাইরাল হওয়া মানেই ডলার আয়ের উৎসমুখে যাওয়া। এই জায়গায় এসে মনে হয় ভাবতে হবে আদৌ যে পরিবর্তনগুলো এসেছে, তার সবই বোধ হয় ইতিবাচক পরিবর্তন কি না।

আর ফেসবুক জগতে কিছু মানুষ আছেন (ফেসবুক সেলিব্রিটি), যাঁরা যেকোনো অকীর্তি, কুকীর্তির পক্ষে বা বিপক্ষে যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেন, তাঁদের ফ্যান-ফলোয়ারও কম নয় এবং এভাবেই তাঁরা ভাইরাল হন। ভাইরাল হওয়া মানেই কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার আয়ের সুযোগ; অর্থাৎ উদ্দেশ্যটা মোটেই সংস্কৃতির পথে চলা নয়, ভাইরাল হয়ে ডলার আয় করাটাই মূল উদ্দেশ্য।

৬. এই সময় সাংবাদিকদের একটি অংশ কী করছে? তারা এই সব বিচিত্র বা অস্বাভাবিক বিষয়গুলো ভাইরাল করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কেন করছে, কারণ তা থেকে ডলার আয় করা যায়।

ফেসবুকের সঙ্গে যুক্ত থাকলে দেখতে পাবেন, কত ধরনের কনটেন্টেই না ভরে উঠেছে তা। একবার সেখানে ঢুকলে বের হওয়া কঠিন ব্যাপার। জাগতিক কাজ তখন ফেসবুক-বিনোদনের কাছে ম্লান হয়ে যায়।

তরুণের দল তো ফেসবুকেও আর থাকে না। ইনস্টাগ্রাম বা ওই ধরনের জগতে তাদের বসবাস। তাহলে বিশ্বটা কারও পাঠশালা নয় এবং কেউই কারও ছাত্র নয়। নেটজগতের সবাই রাজা, আর সেটা কোনো রাজার রাজত্বও নয়, একেবারেই নিজের জগৎ! যা ইচ্ছে তাই করার স্বাধীনতা সেখানে রয়েছে।

৭. এক যুগে যা মূল্যবোধ হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়, পরবর্তী যুগের মানুষ হয়তো তা ভেঙেচুরে নতুন কিছু দাঁড় করায়। একসময় সেটাও পুরোনো হয়ে যায়, নতুন মানুষ নতুন করে ভাঙচুর করে। এটাই হয়ে এসেছে যুগের পর যুগ ধরে। আমরা এখন যে সময়টায় আছি, সেই সময়ে পুরোনো মূল্যবোধ বা নৈতিকতা হয়েছে প্রশ্নের সম্মুখীন। নতুন যা হচ্ছে, তার অনেক কিছুই আমাদের অনেকের চোখেই মসৃণ সংস্কৃতি নয়, কিন্তু আমাদের মূল্যবোধের দেয়ালটা উঠে গেলে এটাকেই তো মেনে নিতে হবে নতুন দিনের সংস্কৃতি বলে!

কিন্তু তাতে কি ডাক্তার পরিচয় দেওয়া এক মানসিক রোগীকে বারবার ক্যামেরার সামনে এনে ‘ওটি’ বা ‘আইসিইউ’ কাকে বলে বা তার ‘ফুল মিনিং’ কী জানতে চাওয়াকেও বিনোদন বা সংস্কৃতির অংশ বলে ধরে নেব, কিংবা কোনো নায়িকা ‘আটটি আম খেয়েছেন’কেও মনে করব গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ? এই সংশয় আমার কাটে না।

লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

RELATED ARTICLES

Leave a reply

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments