বাক্প্রতিবন্ধী দিনমজুর ফয়জুর রহমানের ছয় সদস্যের পরিবারটি নিমেষে নাই হয়ে গেল পৃথিবী থেকে। বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার একটি গ্রামে আটপৌঢ়ে এক টিনের চালাঘরে বসবাস ছিল পরিবারটির। স্বামী-স্ত্রী ও চার সন্তান। গত মঙ্গলবার সেই চালার ওপর ছিঁড়ে পড়ে পল্লী বিদ্যুতের (বিআরইবি) ১১ হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ লাইনের তার।
এ ঘটনায় ফয়জুরের পরিবারের কোনো দায় ছিল না; বরং ভয় ছিল। তাই পল্লী বিদ্যুতের স্থানীয় অফিস এবং সমাজের নানা স্তরে লাইনটি সরানোর জন্য ধরনা দিয়েছেন তিনি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। শেষে জীবন দিয়ে তাঁরা কার দায় মিটিয়ে গেছেন, আমরা জানি না। জানেন পরম করুণাময়। তবে আমরা এটা জানি যে ওই বিদ্যুৎ লাইনের মালিক বিআরইবি। শেষ বিচারে সরকার। স্থানীয় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি লাইনটির হেফাজতকারী।
এই তো সেদিন, ২৯ ফেব্রুয়ারির যে রাত গড়িয়েছে ১ মার্চে, সেই রাতে ঢাকার বেইলি রোডে ‘রেস্তোরাঁর হাট’ হিসেবে খ্যাত গ্রিন কোজি ভবনের অগ্নিকাণ্ডে ৪৪ জন মানুষ নাই হয়ে গেল। তাঁদের মধ্যেও একটি পুরো পরিবার ছিল। আগুন লেগেছিল গ্যাস লিকেজ কিংবা বিদ্যুতের বিভ্রাট থেকে। সেখানে যাঁরা প্রাণ হারালেন, আহত হলেন তাঁদেরও কি কোনো দায় ছিল? তাহলে কার দায় তাঁরা মেটালেন জীবন দিয়ে, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পুড়িয়ে স্থায়ী পঙ্গুত্বের শিকার হয়ে! কারও দায় নেই। কেউ দায়ী হবেন না। শাস্তি পাবেন না। জুড়ীর ঘটনার পরিণতি হবে একই। যাঁরা গেছেন, তাঁরাই গেছেন চিরতরে।
বিদ্যুৎ এবং জ্বালানির কারণে দুর্ঘটনা, প্রাণহানি এখন নিত্যদিনের খবরের অংশ হয়ে গেছে। জাতীয় পর্যায়ে এ-সংক্রান্ত কোনো পরিসংখ্যান খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স, ঢাকা মেডিকেল কলেজের শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ কয়েকটি উৎস থেকে সামগ্রিকতার একটা ধারণা মেলে। সেই অনুযায়ী, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংশ্লিষ্ট দুর্ঘটনায় বছরে হাজার বিশেক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। আহত হয় লাখখানেক। এই হিসাবে অর্থনীতি ও জনজীবনের জন্য অপরিহার্য এই দুটি পণ্য এখন গণমৃত্যুর ফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিয়ে আমাদের সরকারের ভীষণ বড়াই; বিশেষ করে বিদ্যুৎ নিয়ে। আমরা দিয়েছি। আমরা দিচ্ছি। আমরা আরও দেব। কিন্তু কীভাবে যে কী দিচ্ছেন, তা যদি একটু খতিয়ে দেখতেন। ‘মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ’ বলে কথা আছে। তার ছিটেফোঁটাও আমাদের বিদ্যুৎ সিস্টেমে নেই।
আর গ্যাসের কথায় বলতে হয়, সরকার এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহার উৎসাহিত করছে। কিন্তু তার নিরাপত্তার বিষয়টি সম্পর্কে কোনো মাথাব্যথা সরকারের নেই। এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহারের জন্য প্রথমেই দরকার নিরাপদে সিলিন্ডার সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। এ জন্য বিল্ডিং কোডের অনুসরণে শহরাঞ্চলে বাড়ি নির্মাণ অপরিহার্য, যেখানে নিরাপদে গ্যাস সিলিন্ডার সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে। এই বিল্ডিং কোড বাস্তবায়ন করবে কে? তিতাস গ্যাসের লাইনে যে অগণিত ছিদ্র তা মেরামত করে গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা নিরাপদ করবে কে? যার দায়িত্ব, সে যদি না করে বা করতে না পারে, আর সেই কারণে যদি দুর্ঘটনা ঘটে, প্রাণহানি হয়, সে দায় কি কারও নয়? কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনার শিকার হয়ে এভাবে মানুষের মৃত্যুর কোনো প্রতিকার হবে না?
অগ্নিকাণ্ড থেকে সুরক্ষিত থাকার জন্য দেশে রয়েছে ‘অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন ২০২৩’। এই আইন প্রয়োগ করবে কে? যদি কেউ এই আইন না মানে, তাকে আইনের আওতায় এনে শাস্তির বিধান করবে কে? শুধু দুর্ঘটনার পর বললেই হবে যে আমরা সতর্ক করে নোটিশ দিয়েছিলাম। কিন্তু মানেনি। আইন না মানার কি কোনো শাস্তি নেই? কোনো প্রতিকার নেই? মানুষকে বেঘোরে জীবন দিয়ে এর প্রতিকার করতে হবে? জীবন দেওয়ার পরও তো প্রতিকার হয় না। তাহলে কি বিদ্যুৎ-জ্বালানির মৃত্যুফাঁদের মধ্যে বসবাস করাই দেশের মানুষের নিয়তি!
বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনার কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে প্রতিটি বিতরণ সংস্থার নিজস্ব তৈরি নিরাপত্তার বিধিবিধান-সংশ্লিষ্ট গাইডলাইন রয়েছে। এসব গাইডলাইনে যে বিষয়গুলো উল্লেখ রয়েছে, তা প্রায় অভিন্ন। এর প্রায় ৯০ শতাংশ বিদ্যুৎকর্মীদের প্রতিপালনের জন্য। কিন্তু এসব বিধিবিধান যে যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয় না তা নিশ্চিত। কেননা প্রতিটি গাইডলাইনেই বলা হয়েছে, ‘নিরাপত্তার বিধিবিধান যথাযথভাবে অনুসরণপূর্বক অধিক সতর্কতার সঙ্গে কাজ করলে দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব।’
এসব গাইডলাইনে বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনার কারণগুলো তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ১. কারিগরি, ২. অকারিগরি এবং ৩. প্রাকৃতিক। এর মধ্যে কারিগরি কারণগুলো এবং তার প্রতিকার সম্পূর্ণভাবে বিদ্যুৎকর্মীদের বিষয়। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো বৈদ্যুতিক লাইনে কাজ করার সময় শাট-ডাউন গ্রহণ না করা। কখনো কখনো অনিয়মতান্ত্রিক এবং ভুল শাট-ডাউন গ্রহণ করা হয়। ফলে অনেক বিদ্যুৎকর্মী দুর্ঘটনার শিকার হন।
গাইডলাইনের কারিগরি বিষয়ে আরও যে বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, এর মধ্যে যথাযথভাবে লাইন পরিদর্শন ও রক্ষণাবেক্ষণ না করা; ফিডার (মানে গ্রাহক প্রান্তের একটি নির্দিষ্ট লাইন) এবং ওভারলোডেড (মানে কোনো ইকুইপমেন্টের নির্ধারিত ক্ষমতার বেশি বিদ্যুৎ চলাচল করা) করা; পুরোনো বা জরাজীর্ণ লাইন রক্ষণাবেক্ষণ ও নবায়ন না করা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর যেকোনো একটি কারণে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যথাযথভাবে লাইন পরিদর্শন ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে জুড়ীর দুর্ঘটনাটি ঘটত না। তাহলে ওই দুর্ঘটনার দায় তাঁদের যাঁরা যথাযথভাবে লাইন পরিদর্শন ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজটি করেননি।
বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনার অকারিগরি কারণগুলোর মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হলো—বিদ্যুৎকর্মীদের অজ্ঞতা ও অবহেলা; ওয়্যারিংয়ে নিম্নমানের মালামাল ব্যবহার করা এবং সঠিকভাবে ওয়্যারিং না করা; মাসিক নিরাপত্তা মিটিং কিংবা কারিগরি সেমিনারের সিদ্ধান্ত যথাযথভাবে প্রতিপালন না করা; বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা ও দুর্ঘটনার বিষয়ে অজ্ঞতা, অসাবধানতা, উদাসীনতা, সমন্বয়হীনতা ও নিরাপত্তাবিধি যথাযথভাবে প্রতিপালন না করা। এগুলো সব বিদ্যুৎকর্মীদের প্রতিপালনের বিষয়।
তবে গ্রাহক প্রান্তে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সাধারণভাবে ওয়্যারিংয়ে নিম্নমানের মালামাল ব্যবহার করা এবং সঠিকভাবে ওয়্যারিং না করার অভিযোগটি করা হয়। এ বিষয়টির সঙ্গে গ্রাহক যতটা যুক্ত তার চেয়ে বেশি যুক্ত বিদ্যুৎকর্মীরা। কারণ ওয়্যারিং তাঁরাই করেন। মালামালও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁরাই কেনেন। তারপরও বলি, যদি গ্রাহক নিজে নিম্নমানের মালামাল কিনে অদক্ষ কোনো বিদ্যুৎকর্মীকে দিয়ে ওয়্যারিং করিয়েও থাকেন, তাহলে ওই গ্রাহককে বিদ্যুৎসংযোগ দেওয়ার আগে তা পরীক্ষা করা হয় না কেন?
বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনার প্রাকৃতিক কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে বাযুমণ্ডলীয় দুর্যোগ, যেমন ঝড়, বজ্রপাত, ঘূর্ণিঝড়, কালবৈশাখী, টর্নেডো, হারিকেন, জলোচ্ছ্বাস। রয়েছে ভূ-পৃষ্ঠের দুর্যোগ, যেমন বন্যা, নদীতীর ভাঙন, উপকূলীয় ভাঙন, ভূমিধস, মাটির ক্ষয়, অগ্নিকাণ্ড এবং রয়েছে ভূগর্ভস্থ দুর্যোগ, যেমন ভূমিকম্প ও অগ্ন্যুৎপাত। এসব কারণে দুর্ঘটনা হলে আর কারও নিয়ন্ত্রণ থাকে না। কিন্তু অন্যান্য কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে, প্রাণহানি ঘটলে, তার দায় সংশ্লিষ্ট বিতরণ কোম্পানি এবং বিদ্যুৎ বিভাগকে নিতে হবে। শুধু কথার ফুলঝুরি ফুটিয়ে কাজ হবে না।
লেখক: অরুণ কর্মকার, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক