Monday, May 20, 2024
spot_img
Homeমতামতনেতানিয়াহুর চেহারায় ফিরে এসেছে ফেরাউন

নেতানিয়াহুর চেহারায় ফিরে এসেছে ফেরাউন

ফারুক ওয়াসিফ

এমনকি ফেরাউনও এত শিশু হত্যা করেনি, যতটা করেছে নেতানিয়াহুর ইসরায়েলি বাহিনী। মাত্র পাঁচ মাসে ১২ হাজারের মতো শিশু হত্যা করেছে ইসরায়েল। গাজা উপত্যকায়। পৃথিবীর মানুষ হাজারোবার দেখেছে ভিয়েতনামে নামাম বোমায় পুড়ে যাওয়া শরীর নিয়ে ছুটে বেড়ানো নগ্ন ভিয়েতনামি কিশোরীর দুঃসহ ছবিটা। পৃথিবীর মানুষ আবার দেখছে নিষ্পাপের মৃত্যু, ইসরায়েলের বীভৎস নৃশংসতার শিকার ফিলিস্তিনি শিশু-কিশোরদের মুখ। পশ্চিমা সভ্যতা কী করে এর দায় এড়াবে? পৃথিবীর সামনে কোন মুখে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা শোনাবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন?

ফিলিস্তিন। এটা সেই ভূমি, যেখানে পবিত্র মহাপুরুষেরা অবতীর্ণ হয়েছিলেন। বলেছিলেন, তোমার প্রতিবেশীকে হত্যা করো না। এটা সেই ভূমি, যেখানে শিশু সন্তানসম্ভবা মরিয়াম রোমান সেনাদের ভয়ে গোয়ালঘরে জন্ম দিয়েছিলেন যিশুকে। রোমান সেনারা খুঁজে পেলে তাঁকে হত্যা করত। খুঁজে অবশ্য পেয়েছিল। কিছু কুচক্রী ইহুদির ষড়যন্ত্রে মুক্তির দূত যিশুকে হত্যা হতে হয়েছিল ক্রুশকাঠে। সেই পবিত্র ভূমিতে আবারও ফিরে এসেছে ফেরাউনি ত্রাস, শিশুহত্যার হিড়িক। মুক্তির দূতদের গণহত্যা করার উন্মাদ নেশা।

মাত্র পাঁচ মাসে ১২ হাজার শিশু হত্যা মানে প্রতিমাসে দুই হাজার করে শিশু হত্যা করছে ইসরায়েল। শিশুরা ফিলিস্তিনি। শিশুরা নিষ্পাপ। শিশুদের বয়স শূন্য মাস। শিশুদের বয়স কয়েক দিন, কয়েক মাস, কয়েক বছর। শিশুগুলোর নামগুলো কী সুন্দর! মায়ের গর্ভ থেকে মাটিতে পড়ামাত্রই খুন হয়ে যাওয়া ২৬০ সদ্যজাত শিশুর নাম কি জানেন?

নামগুলো কি কেবলই অক্ষর, শিশুগুলো কি কেবলই সংখ্যা? নামের পেছনে মুখ ভেসে ওঠে, মুখ দেখে মায়া জন্মায়। ফেরাউনি বর্বরতার শিকার সেসব মুখ দেখা যায় না। তাদের রক্তাক্ত মুখ, বিধ্বস্ত মাথার খুলি, বোমাবারুদে তছনছ ফেরেশতার মতো শিশুদের মুখ দেখা যায় না। দেখা সম্ভব নয়।

তবু, পাঠক/পাঠিকা, নামগুলো পড়ুন: হুসু, খালেক, আওয়াদ, আল-ফারা, সাইফান, এইদি, নাজওয়া, নিসরিন, উদয়, বাহবানি, জারুশা, জাঈন…

প্রাচীন মিসরে, ফেরাউনি মিসরের শাসকদের মধ্যে ভয় ছিল। তারা জানত তাদের জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে, এমন শিশুর জন্ম হবেই। যেখানেই দুঃশাসন, সেখানেই মুক্তিদাতার আশা কখনও মরে না। ঘাসের বীজের মতো তারা খুব গোপনে একদিন বড় হবে। অত্যাচারী রাজা কংসের মনেও ছিল এই ভয়: ‘তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে।’ তাই ভবিষ্যতের সেই মুক্তিদাতা নবী (মুসা আ.), কিংবা ইসা (আ.) যাতে জন্মাতে না পারে সে জন্যই ফেরাউন থেকে শুরু করে রোমান শাসকরা ফরমান জারি করেন শিশুহত্যার।

ফিলিস্তিনের গাজায় আজ যা হচ্ছে, তা সেই প্রাচীন বর্বরতারই বাস্তবায়ন। ১৪৩ দিনে হত্যা করেছে ৩০ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে, এদের অর্ধেকেরই বেশি নারী ও শিশু। ইসরায়েলিদের ভয় প্রতিটি ফিলিস্তিনি শিশুকে। কারণ, তারা দুর্ধর্ষ– তাদের দমন করা যায় না। যেহেতু দমন করা যাচ্ছে না, সেহেতু হত্যা করো। কিশোর বয়সে তারা পাথর ছুড়বে, যৌবনে হাতে তুলে নেবে ট্যাঙ্কবিধ্বংসী রকেট। তারা তা করবেই। কারণ, স্বাধীনতাহীন জীবন মৃত্যুর সমান, পরাধীন জীবন দাসেরও অধম, লাঞ্ছনার জীবন অসহনীয়। এরকম জীবনে জন্ম যার, সেই শিশুরা বলে না– ‘মা, আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে।’ তারা বলে না সে কথা। তারা মায়ের দুঃখ, মাতৃভূমির দুঃখ দূর করার শপথ নেয় অতি শৈশবেই। সেখানে পিতা শহীদ হলে সন্তান তাঁর জায়গায় এসে দাঁড়ায়। সেখানে ভাইয়ের লাশ কাঁধে তুলে নেয় আরেক ভাই, তারপর আবার এসে দাঁড়ায় প্রতিরোধের প্রথম সারিতে।

ফিলিস্তিনিরা যে এখনও টিকে আছে, সেটা কোনো অস্ত্রের জোরে নয়। সেটা জন্মের জোরে। এমন ত্রাস যে, গর্ভের শিশুও জন্মাতে ভয় পায়! তবুও সেখানে বন্দিশালায়, আধিপত্য ও দখলদারির বিষাক্ত বাতাসে নরনারী মিলিত হয়। শুধু সন্তান জন্মের আশায়। সন্তানই সেখানে জাতি। ইসরায়েলি গণহত্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তারা সন্তানের জন্ম দেয়। হায় সন্তান! এত জন্মায় তবু কমে যায় জাতির আকার। ধ্বংসপ্রায় ফিলিস্তিনি জাতিকে টেকাতে, অজস্র মৃত্যুর সঙ্গে পাল্লা দিতে তাই আরও আরও জন্ম চাই; শহীদদের শূন্যস্থান ভরাট করার জন্য। জন্ম আর মৃত্যুর এ কোন অঙ্ক কষে যাচ্ছে ফিলিস্তিন! কোনো কালো অক্ষর, কোনো সংখ্যা দিয়ে কি সেই হৃদয়চেরা হিসাব নির্ণয় করা যাবে?

তাদের পাল্লা দিতে হয় ইসরায়েলি শিশুদের সংখ্যার সঙ্গেও। দুনিয়ার মধ্যে ইসরায়েলি ইহুদিদের জন্মহার শীর্ষের কোটায়। সন্তানের সংখ্যা বাড়িয়ে তারা ফিলিস্তিনিদের নিজ জন্মভূমিতে সংখ্যালঘু করে দিতে চায়। সে কারণেই হত্যা করে ফিলিস্তিনি শিশুদের। এটা যুদ্ধের পার্শ্বফল নয়, এটা ইসরায়েলি দখলদারি যুদ্ধমেশিনের একটা উদ্দেশ্য। তাই  কেউ যদি মনে করেন, ইসরায়েল ইচ্ছা করে ফিলিস্তিনি শিশু হত্যা করছে না, তাদের বোমায় কিংবা ক্ষুধায় হত্যার আয়োজন শানাচ্ছে না– তিনি ভুল করবেন।

পাইকারি হারে শিশুদের বিনাশ আরেকজনও করেছিলেন। তিনি নাৎসি নেতা হিটলার। শুধু জার্মানি নয়, নাজি বাহিনীর দখলদারির মধ্যে থাকা ইহুদি, যাযাবর জিপসি ও রোমা শিশুদেরও তারা গণহারে হত্যা করেছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবী থেকে ইহুদিদের নামনিশানা মুছে ফেলা। সেই নাজিবাদী ঘৃণা আজ ভর করেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গণহত্যার শিকার হওয়া ইহুদিদের জায়নবাদী গোষ্ঠীর মনে। তারাই আজকের হিটলার, আর ফিলিস্তিনি শিশুরা প্রত্যেকেই সেই আনা ফ্রাংক, যাকে নাজি বাহিনীর হত্যামেশিন থেকে পালিয়ে থাকতে হয়েছিল।

পশ্চিমা করপোরেট গণমাধ্যম আমাদের আনা ফ্র্যাংকের গল্প শুনিয়ে এসেছে। হলিউড গোটা দুনিয়াকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদি গণহত্যার মর্মান্তিক কাহিনী চিত্রায়িত করে গেঁথে দিয়েছে আমাদের মনে। বিশ্বজুড়েই রয়েছে হলোকস্ট ইন্ডাস্ট্রি, যাদের কাজ হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদিদের করুণ পরিণতির কথা মনে করিয়ে দিয়ে আধুনিক ইসরায়েল রাষ্ট্রের যাবতীয় পাপকে ঢেকে রাখা। হলোকস্টের চাদরে তারা ঢাকতে চায় তাদের বর্বরতার মুখ।

কিন্তু পাপ শুধু চাপা থাকে না, তার বাপকেও ছাড়ে না। খোদ যুক্তরাষ্ট্রে এক মার্কিন বিমানসেনা ফিলিস্তিনি গণহত্যার বিকার সইতে পারেননি। অ্যারন বুশনেল নামে এই যুবক সেনা পরিপাটি সামরিক পোশাক পরে, ধীরস্থিরভাবে হেঁটে ইসরায়েলি দূতাবাসের সামনে দাঁড়িয়ে গায়ে আগুন দেন। মৃত্যুর মুখেও তাঁর অবিচল কণ্ঠ থেকে বেরুতে থাকে এক মহামন্ত্র: ফ্রি প্যালেস্টাইন, ফ্রি প্যালেস্টাইন। বিশ্বজুড়েই কোটি কোটি মানুষকে এই মন্ত্র স্পর্শ করেছে। আগের চেয়ে আরও বেশি করে সমর্থন পাচ্ছে ফিলিস্তিন। কিন্তু দুনিয়ার মালিক বনে বসে আছেন যারা, যারা ব্যবসা, মিডিয়া এবং বাহিনীগুলোর নিয়ন্ত্রণে তাদের হৃদয় শয়তানের কাছে বিক্রি করে দেওয়া, তাদের মনে বর্বরতার মোহর মারা, তাদের আত্মায় হিব্রু ইশ্বরের ঘৃণা– যে ঘৃণায় তিনি পুড়িয়ে দিয়েছিলেন সোডোম ও গোমরাহ নামের দুটি শহর। সেই একই ঘৃণা নিয়ে তারা ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এবং গংয়ের পেছনে সামিল হয়েছে। সেই একই জিঘাংসা নিয়ে তারা গুঁড়িয়ে দিচ্ছে গাজা ও রাফা শহর।

এই গণহত্যা তিন মাস ধরে চলছে। তিন মাস ধরে আমরা বিশ্বাস করে গেছি, মানবতা আবার জেগে উঠবে। না, মানবতা জাগেনি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে, মানবতা জাগেনি আরব বাদশাহদের প্রাসাদে, মানবতা জেগে উঠেছে এক মার্কিন সেনার গায়ের আগুনে। সেই আগুন বলছে, মানবতা পুড়ছে ফিলিস্তিনে, তোমরা তাকে বাঁচাও।

হ্যাঁ, আজকে ফিলিস্তিনই হলো মানবতার প্রাণভোমরা। ফিলিস্তিন বাঁচলে বিশ্বমানবতা বাঁচবে, গাজার শিশুরা বোমার আঘাতে কিংবা ক্ষুধার জ্বালায় যতদিন মরবে, ততদিন মানবতা নামক ধারণার যোগ্য হবে না এই সভ্যতা।

RELATED ARTICLES

Leave a reply

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments