Thursday, May 9, 2024
spot_img
Homeমতামতপ্রসঙ্গ বুয়েট: ছাত্ররাজনীতি ‘হ্যাঁ’, ছাত্ররাজনীতি ‘না’

প্রসঙ্গ বুয়েট: ছাত্ররাজনীতি ‘হ্যাঁ’, ছাত্ররাজনীতি ‘না’

জাতীয়ভাবে সংগঠিত ছাত্রসংগঠনগুলো ছাত্রদের শিক্ষাজীবন সুচারুভাবে চালাতে ও সার্বিক মানবিক-সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য তাঁদের নানা প্রয়োজন, চাহিদা ও সুযোগ-সুবিধার জন্য কাজ করবে, ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে, প্রয়োজনে আন্দোলনও করবে, কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করবে না—এটাই হওয়া উচিত নীতি।

হঠাৎ করেই অশান্ত হয়ে উঠেছে দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার অন্যতম পীঠস্থান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেনের বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা সত্ত্বেও রাতের বেলায় ক্যাম্পাসে যাওয়াকে কেন্দ্র করে একদল শিক্ষার্থী আন্দোলন শুরু করায় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সদস্যের হলের সিট বাতিল করা হয়। এ নিয়ে শুরু হওয়া পক্ষ-বিপক্ষের বাদানুবাদ গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের পক্ষে যেমন জোরালো মত আছে, তেমনি ছাত্ররাজনীতির পক্ষের মতামতও কম নয়।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষের ২০১৯ সালের জারি করা জরুরি বিজ্ঞপ্তি স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত কেন অবৈধ হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আদালত। বিচারপতি মো. খসরুজ্জামান ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ার কাজলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ সোমবার এ আদেশ দেন। এই আদেশের ফলে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি চলতে আর কোনো আইনগত বাধা নেই।

হাইকোর্টের এই আদেশকে স্বাগত জানিয়েছেন বুয়েটের উপাচার্য ও ছাত্রলীগের নেতারা। তবে ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’ পরিচয়ে আন্দোলনকারীরা ছাত্ররাজনীতি বর্জিত ক্যাম্পাসের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন। কিন্তু এই আন্দোলনকারীরা ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবির কিংবা হিযবুত তাহরীরের মতো সাম্প্রদায়িক সংগঠনের তৎপরতা নিয়ে কোনো কথা না বলায় এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে তাদের উদ্দেশ্য সৎ ও মহৎ নয়।

বুয়েটের একজন শিক্ষার্থী আবরার হত্যাকাণ্ডের পর ২০১৯ সালের অক্টোবরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্রসংগঠন ও সংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একটি জরুরি নোটিশ জারি করে। এই আদেশের বিরুদ্ধে রিট করা হয় এই যুক্তিতে যে, বুয়েটের এই সিদ্ধান্ত দেশের সংবিধানের ৩৭, ৩৮ এবং ৩৯ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। সমাবেশ করা, রাজনৈতিক দল করা ও বাক্‌স্বাধীনতা আমাদের মৌলিক অধিকার। তবে বুয়েটের অর্ডিন্যান্স ১৯৬১-এ ভিসি এবং প্রো-ভিসিকে একটা ক্ষমতা দেওয়া আছে, তাঁরা ছাত্ররাজনীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু পদক্ষেপ নিতে পারবেন। এর ফলে তাঁরা মিছিল-মিটিং করার ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারবেন। তবে কোনো সংগঠন নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা তাঁদের নেই। আদালত রিট আবেদনকারীর বক্তব্য শুনে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে জরুরি ভিত্তিতে জারি করা নোটিশ স্থগিত করেছেন এবং এই নোটিশ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন।

সিনিয়র আইনজীবী ও সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন মনে করেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতি থেকে গণতান্ত্রিক ধারা এবং নেতৃত্ব বেরিয়ে আসে। যেখানে সংবিধানে আমাদের মৌলিক অধিকার সংরক্ষিত আছে, সেখানে কোনোভাবেই কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বাধা দিতে পারে না। সংবিধান পরিপন্থী কোনো সিদ্ধান্ত কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নিতে পারবে না।’ হাইকোর্টের আদেশের বিষয়ে বুয়েট উপাচার্য অধ্যাপক ড. সত্য প্রসাদ মজুমদার বলেন, ‘কোর্টের আদেশ শিরোধার্য। কোর্ট যেটা বলবেন, সেটি আমাদের মানতে হবে। কোর্টের অবমাননা আমরা করতে পারব না। সেটি করতে গেলে আমাকে আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই করতে হবে।’

এই রায়ের ফলে খুশি হয়েছে ছাত্রলীগ। আবরার হত্যার অভিযোগ ছিল ছাত্রলীগের বিরুদ্ধেই। বিচারে যাঁদের শাস্তি হয়েছে, তাঁরা সবাই ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে ছাত্রলীগ সাংগঠনিকভাবেই অস্বস্তিতে ছিল। প্রায় চার বছর পর উচ্চ আদালতের রায়ের পর ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বুয়েটের শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা, নেতৃত্ব বিকাশ ও বুয়েটের শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের জন্য সেখানে যেন নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা হয়।

ছাত্ররাজনীতির মধ্যে যদি কোনো নেতিবাচক উপাদান থেকে থাকে তা দূর করার অঙ্গীকার করে সাদ্দাম হোসেন বলেছেন, একাডেমিক পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছাত্ররাজনীতি নিশ্চিত করা, গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপযোগী ছাত্ররাজনীতির জন্য বুয়েট প্রশাসন যদি কোনো নিয়মনীতি করে, যা সংবিধান ও বুয়েট অর্ডিন্যান্সের সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকে, সেটিকে ছাত্রলীগ স্বাগত জানাবে।

অন্যদিকে, ছাত্ররাজনীতিবিহীন বুয়েটের পরিবেশ সবচেয়ে বেশি নিরাপদ ও শিক্ষাবান্ধব বলে মন্তব্য করেছেন বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। রায় ঘোষণার পর এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘আমরা বুয়েটের শিক্ষার্থীরা দেশের বিচারব্যবস্থার প্রতি সম্পূর্ণ সম্মান ও আস্থা রাখি।’ বুয়েট ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও ২৮ মার্চ মধ্যরাতে ক্যাম্পাসে বহিরাগত রাজনীতিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আগমন এবং শোডাউনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিমালার লঙ্ঘন বলে মনে করেন বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, কোনো কারণে মৃত্যু বা হতাহতের ঘটনা ঘটলেই কি ‘নিষিদ্ধ’ করার দাবি তোলা যায়? দেশে রাজনৈতিক কারণে তো প্রায় প্রতিদিনই মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। তাই বলে কি এখন রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি তোলা হবে? প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে, সে জন্য কি সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধের দাবি তোলা হবে? ছাত্র আন্দোলন বা ছাত্ররাজনীতিতে কীভাবে ক্ষতিকর প্রবণতা ঢুকল, কার কূটচালে ছাত্রসংগঠনগুলো রাজনৈতিক দলের লেজুড়ে পরিণত হলো, সেসব নিয়ে আমাদের কোনো আলোচনা নেই। আমরা মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার পরামর্শ দিতে পারদর্শী হয়ে উঠেছি।
উচ্চ আদালত বুয়েটে রাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়ে যে রায় দিয়েছেন তারও পক্ষে-বিপক্ষে নানা রকম মতামত প্রকাশ পাচ্ছে। আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে সরকার সুবিধা নিল কি না, সে প্রশ্নও উঠছে। এগুলো ভালো লক্ষণ। প্রশ্ন থাকা ভালো, কিন্তু সিদ্ধান্তহীনতা ভালো না।

‘ছাত্ররাজনীতি’র মধ্যে যেসব খারাপ প্রবণতা ঢুকে পড়েছে, সেগুলো দূর করার জন্য আন্দোলন না করে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের পক্ষে ওকালতি করা সুস্থ চিন্তার বহিঃপ্রকাশ বলে মেনে নেওয়া যায় না। আমাদের দেশের অতীত অভিজ্ঞতার আলোকেই এটা বলা যায় যে ছাত্রদের সংগঠন করা সব সময় খারাপ ফল দেয় না। তা ছাড়া প্রাপ্তবয়স্ক ছাত্রদের রাজনীতি করার অধিকার হরণ করা কোনোভাবেই সুবুদ্ধির পরিচয় বহন করে না। জাতীয়ভাবে সংগঠিত ছাত্রসংগঠনগুলো ছাত্রদের শিক্ষাজীবন সুচারুভাবে চালাতে ও সার্বিক মানবিক-সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য তাঁদের নানা প্রয়োজন, চাহিদা ও সুযোগ-সুবিধার জন্য কাজ করবে, ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে, প্রয়োজনে আন্দোলনও করবে, কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করবে না—এটাই হওয়া উচিত নীতি।

রাজনৈতিক দলগুলোও ছাত্র ঠ্যাঙ্গাড়ে পুষবে না। যে প্রাপ্তবয়স্ক ছাত্ররা রাজনীতি করতে চান, তাঁরা রাজনৈতিক দলের সদস্য হবেন। রাজনৈতিক দলগুলো তাঁদের নিয়ে দলীয় ছাত্র ব্রিগেডও গঠন করতে পারে। অনুরূপ ছাত্ররা ক্যাম্পাসে তাঁদের দলের পক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে প্রচার চালাতে, এমনকি জাতীয় নির্বাচনের সময় শিক্ষকের অনুমতি নিয়ে ক্লাসে ঢুকেও পাঁচ-দশ মিনিট নিজ নিজ দলের পক্ষে প্রচার চালাতে পারেন।

কিন্তু ‘ছাত্ররাজনীতি’র নামে রাজনৈতিক দলের লেজুড় বাহিনী হয়ে ক্যাম্পাসসহ বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারের জন্য নানা তাণ্ডব করা, ধর্ষণসহ খুনখারাবির মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়াটা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।

এখন দেখার বিষয়, হাইকোর্টের আদেশে বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির বাধা অপসারিত হলেও সব ছাত্রসংগঠন সমান সুযোগ নিয়ে তা চর্চা করার অধিকার ও পরিবেশ পায় কি না! বর্তমানে কি ছাত্রলীগ ছাড়া ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র মৈত্রী প্রভৃতি সংগঠন ক্যাম্পাসে সমান সুযোগ ও নিরাপদ পরিবেশ পাবে? শুধু শাসকদলের পেটোয়া সংগঠনের একচেটিয়া কর্তৃত্বের নাম কখনো ‘ছাত্ররাজনীতি’ হতে পারে না।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিধিমোতাবেক ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচন হয় না বছরের পর বছর। আগে ছাত্রদের এই নির্বাচিত সংসদগুলোর মাধ্যমে পাঠ-অতিরিক্ত ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, ম্যাগাজিন প্রকাশ প্রভৃতি সাংস্কৃতিক কার্যক্রম দ্বারা ছাত্রছাত্রীদের সাংগঠনিক ও নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জনের অনুশীলন হতো। সেখানে প্রতিযোগিতা থাকত, কিন্তু রাজনৈতিক দলীয় স্বার্থে হীন রেষারেষি ও হানাহানি থাকত না। দেশে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত রাজনৈতিক দলগুলোর হীন স্বার্থে ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনী পোষার জন্যই কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বৈধ ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচন লাগাতার বন্ধ রাখা হচ্ছে?

বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ বিষয়গুলোর দিকেও নজর দিতে হবে। কোনো ছাত্রসংগঠন অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়লে মুরব্বি রাজনৈতিক দলকে তার দায় নিতে হবে। অসুস্থ ধারার বিপরীতে ছাত্র আন্দোলনে সুস্থ ধারা ফিরে আসুক। মেধাবী শিক্ষার্থীরা রাজনীতি থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখলে রাজনীতির দীনতা ঘুচবে না। ছাত্ররাজনীতিকে এককথায় ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ না বলে আমাদের অবস্থান হোক ভালোর পক্ষে।

বিভুরঞ্জন সরকার, জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

RELATED ARTICLES

Leave a reply

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments