মোঃ শাহজালাল, বরগুনা:
আমতলী-কুয়াকাটা আঞ্চলিক মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার নিয়ন্ত্রণহীন দৌরাত্ম্য দিন দিন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। অনিয়ন্ত্রিত যান চলাচল, মহাসড়কের ওপর যত্রতত্র অটোরিকশা স্ট্যান্ড, বিভিন্ন অজুহাতে পরিবহন শ্রমিক ও যাত্রীদের নিকট থেকে টাকা আদায়, সব মিলিয়ে পুরো রুটজুড়ে এক ধরনের অরাজক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। পর্যটন ও বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কে প্রতিদিনই বাস, মিনিবাস, ট্রাক, মালবাহী গাড়ি ও পর্যটকবাহী যানবাহনকে এই নৈরাজ্যের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে দীর্ঘদিন ধরে একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। তারা রাস্তার দুই পাশে অটোরিকশা সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে রাখে, যার ফলে মূল সড়কে স্বাভাবিক যান চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজট। অভিযোগ রয়েছে, এ রুটে চলাচলকারী বড় পরিবহনগুলোকে প্রায়ই থামিয়ে ৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত ‘স্ট্যান্ড ফি’ বা ‘লাইন ফি’ নামে আদায় করা হয়।
স্থানীয়রা বলছেন, এসব আদায়ের বেশিরভাগই সরাসরি চাঁদাবাজি, যেটি কোনোভাবেই বৈধ নয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নিয়মিত যাত্রী জানান, আমতলীর একটি রাজনৈতিক দলের এক প্রভাবশালী নেতার পুত্র, যিনি একাধিক ডাকাতি মামলার আসামি ও এলাকাবাসীর কাছে সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত, তিনিই এই রুটের পুরো পরিচালনার নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন। তার নেতৃত্বে থাকা গোষ্ঠীর কারণে চাঁদাবাজির মাত্রা আগের চেয়ে কয়েক গুণ বেড়েছে। প্রতিদিনই সাধারণ যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকেরা নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
এই পরিস্থিতির সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী যাত্রীরা। তাদের অভিযোগ, হঠাৎ করে ভাড়া বাড়ানো, অতিরিক্ত স্ট্যান্ড ফি আদায় এবং যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকার কারণে যাতায়াত সময় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আমতলী ও কলাপাড়া অংশে প্রায়ই বাস ও অটোরিকশার মধ্যে ছোটখাটো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে, যা বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা বাড়িয়ে তোলে। গত কয়েক বছরে এই রুটে অটোরিকশা-সংক্রান্ত একাধিক প্রাণহানির ঘটনাও এলাকায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।
পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটাগামী সড়ক হওয়ায় এই বিশৃঙ্খলা স্থানীয় অর্থনীতির ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। পর্যটকদের অভিযোগ, রুটজুড়ে অনিয়ম ও যানজটের কারণে অনেকে ভ্রমণ এড়িয়ে চলছেন। ফলে হোটেল, রেস্তোরাঁ, বাজার ও পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের আয় হ্রাস পাচ্ছে।
অটোরিকশার আধিক্য এবং ব্যস্ততম জায়গাগুলোতে এলোমেলো অবস্থান যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ। ফেরীঘাট, এ.কে. স্কুল চৌরাস্তা, বড়চৌরাস্তা এবং বটতলা বাস স্ট্যান্ড এলাকায় প্রতিদিনই অটোরিকশার চাপ সবচেয়ে বেশি। সম্প্রতি আমতলী–কুয়াকাটা মহাসড়কে একটি দুর্ঘটনায় ৩ জন নিহত ও ৪ জন আহত হওয়ার ঘটনা স্থানীয়দের উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। অনিয়ন্ত্রিত অটোরিকশা ও ভারী যানবাহনের সংঘর্ষের ঝুঁকি দিনে দিনে বাড়ছে।
অন্যদিকে পরিবহন মালিক ও চালকরা বলছেন, বৈধ টোল ছাড়া কোনো ধরনের টাকা আদায় আইনসম্মত নয়। এভাবে চাঁদাবাজি চলতে থাকলে পরিবহন খাত ভেঙে পড়বে এবং যাত্রীদের নিরাপত্তা সম্পূর্ণ ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে। তারা প্রশাসনের কঠোর নজরদারি ও স্থায়ী সমাধানের দাবি তুলেছেন। মাঝেমধ্যে অভিযান চালানো হলেও তা স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারছে না।
স্থানীয় সচেতন মহলের মত, মহাসড়কে অটোরিকশার জন্য নির্দিষ্ট স্ট্যান্ড স্থাপন, অবৈধ স্ট্যান্ড উচ্ছেদ, অনিয়ন্ত্রিত যানবাহন অপসারণ এবং নিয়মিত মনিটরিংয়ের মাধ্যমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা জরুরি। নয়তো দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন ও বাণিজ্যিক এই সড়কটি পুরোপুরি নৈরাজ্যের দখলে চলে যাবে।
সড়কটির নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, চাঁদাবাজি বন্ধ করা এবং বৈধ পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি, এমনটাই মনে করেন স্থানীয়রা।

