আল-আমিন বিশেষ প্রতিনিধি শেরপুর:
শেরপুরের সীমান্তঘেঁষা ঝিনাইগাতীর পাহাড়ি জনপদে গারো সম্প্রদায়ের প্রাচীন ঐতিহ্য, কৃতজ্ঞতা আর নতুন ফসলের আনন্দকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে তিন দিনব্যাপী ‘ওয়ানগালা’ উৎসব। বৃহস্পতিবার সকাল ১১টার দিকে গারো জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতি ও আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে উৎসবের উদ্বোধন করেন ধানশাইল খ্রিস্টীয় ব্যান্ড সোসাইটির বিশপ প্যাট্রিক ডি. রোজারিও।
ঐতিহ্যে ভরপুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় গারো নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন খ্রিস্টীয় সংগঠনের প্রতিনিধি, সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এবং দূর-দূরান্ত থেকে আগত গারো জনগোষ্ঠীর নারী-পুরুষ। ঐতিহ্যবাহী রঙিন পোশাক, ঢাক–নগাড়ার গম্ভীর তালে নৃত্য, অতিথিদের বিশেষ স্কার্ফ পড়িয়ে বরণ আর প্রার্থনার মাধ্যমে উৎসবস্থল মুখর হয়ে ওঠে।
উদ্বোধনী বক্তব্যে বিশপ প্যাট্রিক ডি. রোজারিও বলেন,
“ওয়ানগালা কোনো আনুষ্ঠানিকতা নয়; এটি জীবনের প্রতি কৃতজ্ঞতার উৎসব। জীবনের যা ভালো, যা অর্জিত—সবকিছুকেই আমরা এই উৎসবের মাধ্যমে ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই। আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ঐতিহ্য আমাদের পরিচয়। আমরা যদি তা ধরে না রাখি, ভবিষ্যৎ প্রজন্মও তাদের শেকড় হারাবে।”
তিনি আরও বলেন, “গারো জনগোষ্ঠী যুগ যুগ ধরে প্রাকৃতিক সম্পদের সঙ্গে নিবিড় বন্ধন রেখে জীবনযাপন করে আসছে। ওয়ানগালা সেই সম্পর্কেরই এক উজ্জ্বল উদযাপন। সমাজের প্রতিটি মানুষকে এই উৎসবে আন্তরিকভাবে শামিল হতে হবে।”
তিন দিন ধরে বর্ণিল আয়োজন
এই তিন দিনে থাকবে—
ঐতিহ্যবাহী নৃত্য–গান
গারো সংস্কৃতির বিশেষ ড্রাম ‘দাঁরু’র তালে নাচ
ধান তোলার প্রতীকী আচার
ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান
স্থানীয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতি বিষয়ক আলোচনা
গারো তরুণদের পরিবেশনা
ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা
সামাজিক মিলনমেলা এবং অতিথি আপ্যায়ন
উৎসব উপলক্ষে গারো জনগোষ্ঠীর ঘরে ঘরে চলছে বিশেষ রান্না, রঙিন সাজসজ্জা এবং অতিথি আপ্যায়নের প্রস্তুতি। নারী-পুরুষ, শিশু, তরুণ—সবাই অংশ নিচ্ছে নিজ নিজ সাংস্কৃতিক উপস্থাপনায়।
গারো জনপদে উৎসবের আমেজ
গারো জনগোষ্ঠীর জন্য ওয়ানগালা শুধু ফসল উৎসব নয়; এটি তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, সামাজিক বন্ধন এবং আনন্দ–উচ্ছ্বাসের এক বিস্ময়কর সম্মিলন। নতুন ফসলের প্রতি কৃতজ্ঞতা, প্রকৃতি ও পূর্বপুরুষদের স্মরণ এবং সমাজে ঐক্যের বার্তা ছড়িয়ে দেয় এই উৎসব।
উৎসবকে কেন্দ্র করে আশপাশের গারো গ্রামগুলোতেও চলছে আনন্দ-উচ্ছ্বাস। প্রবাসী অনেকেই দেশে ফিরে অংশ নিচ্ছেন এই মিলনমেলায়। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মাঝেও যুক্ত হয়েছে বাড়তি উৎসাহ, কারণ উৎসবকে কেন্দ্র করে এলাকার বাজারগুলোতেও জমে উঠেছে বেচাকেনা।
আয়োজনে সমাজের সকলে
ওয়ানগালা উৎসব আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে ঝিনাইগাতী খ্রিস্টীয় স্যমিন এন্ড সোসাইটি। তাদের সহযোগিতায় গারো তরুণ–তরুণীরা দলবেঁধে উৎসবকে বর্ণময় করে তুলছে।
উৎসব আয়োজকেরা জানান, “ওয়ানগালা আমাদের সংস্কৃতির প্রাণ। আমরা চাই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই উৎসবের মর্ম, ইতিহাস ও গুরুত্ব সম্পর্কে জানুক। তাই আমরা প্রতিবছর আরও বড় পরিসরে আয়োজন করার চেষ্টা করি।”

