মোঃ মিজানুর রহমান,ভোলা প্রতিনিধিঃ
ভোলার চরফ্যাশনের মেঘনায় জেলেদের জালে ধরা পড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ। এতে জেলেপাড়াসহ চরফ্যাশনের মৎস্যঘাটগুলোতে রুপালি ইলিশে সরগরম পরিবেশ বিরাজ করছে, ছড়াচ্ছে উৎসবের আমেজ। ফলে জেলে, পাইকার আর আড়তদারদের কর্মব্যস্ততা বেড়েছে। তাদের হাঁক-ডাকে মুখর হয়ে উঠেছে ইলিশের আড়ত। প্রতিদিন মৎস্যঘাটগুলোতে কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে।
কিন্তু জেলেদের ঘরে নেই সেই আনন্দের ছোঁয়া। প্রাপ্য মূল্য না পাওয়ায় ধারদেনার বোঝা নিয়েই বাঁচতে হচ্ছে তাদের। জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি মৌসুমের শুরুটা ভালো কাটেনি। মেঘনায় ইলিশের সংকট থাকায় ধারদেনা করে চরম অভাবে পড়েছেন তারা।
ভোরের আলো ফুটতেই চরফ্যাশনের সামরাজ মৎস্যঘাট জমে ওঠে রুপালি ইলিশের উৎসবে। সারি সারি ট্রলার ভিড়ছে ঘাটে, ঝুড়িভর্তি ইলিশ নামছে একের পর এক। হাঁকডাক, দরদাম আর চিৎকারে মনে হয় যেন মেলা বসেছে। কোটি টাকার বেচাকেনায় সরগরম আড়ত।
কিন্তু এই উৎসবের ঝলকানি কেবল বাইরে। ভেতরে লুকিয়ে আছে বঞ্চনার দীর্ঘশ্বাস। সাগরে প্রাণ হাতে নিয়ে যারা মাছ ধরে, সেই জেলেদের ঘরেই তিনবেলা ভাত জোটে না।
সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) সামরাজ মৎস্যঘাটে দেখা হয় পঞ্চাশোর্ধ্ব ইউসুফ মাঝির সঙ্গে। হতাশার সুরে তিনি বলেন, “জালে মাছ পাই, কিন্তু ঘরে চাল হয় না। জালে স্বপ্ন ধরি, চুলায় ভাত জোটে না। তার ওপর আড়তদারের চাপে নদীতেই কাটে আমাদের জীবন।”
তরুণ জেলে মোশাররফ ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, “ঘাটে কোটি টাকার বেচাকেনা হয়, অথচ আমাদের কাছ থেকে শতকে ৭ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত কমিশন কেটে নেয় মৎস্য আড়তদাররা। এর ফলে লোকসান গুনতে হয়। দেনার দায়ে ঘরে টাকা পৌঁছায় না, অভাব লেগেই থাকে।”
সরেজমিনে উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজার ঘুরে দেখা যায়, ইলিশ যেন সোনার হরিণ। এক হালি বড় ইলিশ ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা, মাঝারি সাইজ ৪ হাজার টাকার ওপরে, ছোট ইলিশও ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা। ফলে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে জাতীয় মাছ।
উপজেলার হাজারীগঞ্জের বাসিন্দা টমটম চালক জামলা আক্ষেপ করে বলেন, “দিনে ৫ থেকে ৬ শত টাকা আয় করি। এক হালি ইলিশ কিনতে গেলে তিন দিনের আয় শেষ হয়ে যায়। বাজারে যাই, কিন্তু কিনতে পারি না—শুধু তাকিয়ে ফিরে আসি।”
স্থানীয় কলেজছাত্র রায়হান জানান, “শৈশবে নিয়মিত ইলিশ খেতাম। এখন বাবার কাছে মাছ খাওয়ার আবদার করতেও লজ্জা লাগে। ইলিশ যেন এখন কেবল ধনীদের খাবার।”
সামরাজ মৎস্যঘাটের আড়তদার মো. ফারুক জানান, “আমরা লাখ লাখ টাকা দাদন দিই। জেলেরা বছরের পর বছরেও মাছ ধরে সেই টাকা শোধ করতে পারে না। তাছাড়া জেলেরা নদী বা সাগর থেকে মাছ শিকার করে ঘাটে এলে ট্রলার থেকে মাছ নামানো, বরফ, পরিবহনসহ নানা খরচ থাকে—সব মিলিয়ে ঝুঁকি ছাড়া লাভ নেই।”
চরফ্যাশন উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা জয়ন্ত কুমার আপু বলেন, “ইলিশ আহরণে সবচেয়ে বেশি কষ্ট করেন জেলেরা। অথচ বাজার ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা ও আড়তদারদের একচেটিয়া দৌরাত্ম্যের কারণে তাদের প্রাপ্য লাভ ঘরে পৌঁছায় না। আড়তে কোটি টাকার লেনদেন হলেও জেলেদের সংসারে দেনার চাপ লেগেই থাকে। যে সব আড়ত মালিক জেলেদের কাছ থেকে অতিরিক্ত মুনাফা নিচ্ছে—জেলেদের পক্ষ থেকে অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

