• আজকের পত্রিকা
  • ই-পেপার
  • আর্কাইভ
  • কনভার্টার
  • অ্যাপস
  • অবহেলিত উপকূলের দাবি: নোয়াখালী বিভাগ আন্দোলনের এক শতাব্দীর ইতিহাস 

     swadhinshomoy 
    16th Oct 2025 2:36 pm  |  অনলাইন সংস্করণ Print

    রিয়াজুল ইসলাম, নোয়াখালী প্রতিনিধি:

    বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের ঐতিহ্যবাহী জেলা নোয়াখালী—ইতিহাস, সংস্কৃতি, বাণিজ্য ও রাজনৈতিক চেতনার এক অনন্য মিলনভূমি।
    এই জেলার মানুষ দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন একটি আলাদা প্রশাসনিক “নোয়াখালী বিভাগ” ঘোষণার।
    কিন্তু এই দাবির শিকড় অনেক গভীরে—প্রায় এক শতাব্দীরও বেশি পুরোনো এক চেতনার ইতিহাসে।

    নোয়াখালীর প্রাচীন নাম ছিল ভুলুয়া। ব্রিটিশ শাসনামলে, ১৭৭২ সালে, এখানে জেলা প্রশাসনের ভিত্তি স্থাপিত হয়।
    এরপর ১৮৬৮ সালে, এক ভয়াবহ বন্যার পর নদীপথ পরিবর্তিত হয় এবং নতুন একটি খাল খনন করা হয়।
    সেই নতুন খাল থেকেই জেলার নতুন নাম হয় “নোয়াখালী”, অর্থাৎ “নতুন খাল”।

    ভৌগোলিকভাবে নোয়াখালী বাংলাদেশের অন্যতম উপকূলীয় জেলা।
    দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, উত্তরে ফেনী, পূর্বে চট্টগ্রাম ও পশ্চিমে লক্ষ্মীপুর—এই চারপাশে নদী ও খালবেষ্টিত অঞ্চলটির অর্থনীতি ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে নদীনির্ভর সমাজ কাঠামোর উপর ভিত্তি করে।

    নোয়াখালীর শিক্ষা আন্দোলনের সূচনা ঘটে ১৮৫০ সালে নোয়াখালী জিলা স্কুল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে।
    এটি শুধু একটি বিদ্যালয় নয়—বরং নোয়াখালীর শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক জাগরণের আলোকবর্তিকা।
    পরবর্তীতে জেলার বিভিন্ন স্থানে মাদ্রাসা, পাঠশালা ও হিন্দু-মুসলিম মিশ্র বিদ্যালয় গড়ে ওঠে, যা এক নতুন বুদ্ধিজীবী শ্রেণির জন্ম দেয়।

    ১৮৯৬-১৯০৩ সালের মধ্যে চট্টগ্রাম থেকে ফেনি হয়ে লাকসাম ও নোয়াখালী পর্যন্ত রেললাইন চালু হয়, যা এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে নতুন গতি আনে।
    নোয়াখালী বাজার, মাইজদী, সোনাপুর, বেগমগঞ্জ, ও চাটখিল হয়ে গড়ে ওঠে আঞ্চলিক বাণিজ্যকেন্দ্র।
    এই সময় থেকেই স্থানীয় ব্যবসায়ী ও শিক্ষিত সমাজ প্রশাসনিক স্বাবলম্বিতার দাবি তুলতে শুরু করে—যা পরবর্তীতে বিভাগ আন্দোলনের ভিত্তি তৈরি করে।

    নোয়াখালী শুধুমাত্র প্রশাসনিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি সংস্কৃতি, ধর্মীয় সহাবস্থান ও মানবিকতার প্রতীক।

    এখানে রয়েছে—
    ঐতিহাসিক বজরা শাহী মসজিদ,
    গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট (যেখানে মহাত্মা গান্ধী ১৯৪৬ সালে দাঙ্গা-পরবর্তী শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবস্থান করেছিলেন),
    সোনাপুর জমিদারবাড়ি,
    এবং অসংখ্য পুরাকীর্তি।

    নোয়াখালীর লোকসংস্কৃতি, পল্লীগান, বাউল সঙ্গীত, হস্তশিল্প ও নকশিকাঁথা আজও বাঙালির জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
    স্থানীয় উপভাষা “নোয়াখাইল্লা ভাষা” বাংলাদেশের অন্যতম প্রাণবন্ত উপভাষা, যার স্বকীয়তা ও মজার উচ্চারণ মানুষের পরিচয়ের অংশ।

    ঐতিহাসিক দলিল ও স্থানীয় গবেষকরা মনে করেন, প্রায় ১০০ বছর আগে ১৯১০ সালের দিকে নোয়াখালী জেলার শিক্ষিত শ্রেণি ও ব্যবসায়ী সমাজ প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা শুরু করেন।
    তাদের লক্ষ্য ছিল—এই বৃহৎ উপকূলীয় অঞ্চলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও পরিবহন উন্নয়নের সুযোগ তৈরি করা।

    যদিও তখন কোনও সংগঠিত আন্দোলন শুরু হয়নি, তবুও এই সময়কে “নোয়াখালী বিভাগ আন্দোলনের চেতনার সূচনালগ্ন” বলা হয়।

    দীর্ঘ সময় পরে, ১৯৯০-এর দশকে, নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থী, সমাজকর্মী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে নোয়াখালী বিভাগ আন্দোলন নতুন করে শুরু হয়।

    ১৯৯৪ সালে “নোয়াখালী বিভাগ বাস্তবায়ন পরিষদ” নামে একটি সংগঠন গঠিত হয়।
    তাদের ১০ দফা দাবির মধ্যে অন্যতম ছিল—
    ‘নোয়াখালীকে স্বতন্ত্র প্রশাসনিক বিভাগ ঘোষণা,
    ‘হাতিয়াকে নতুন জেলা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা,
    ‘বাণিজ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি।

    এই পরিষদ গণঅনশন, মানববন্ধন ও স্মারকলিপি কর্মসূচি পালন করে এবং আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক ভিত্তি স্থাপন করে।

    বর্তমান সময়েও আন্দোলনটি নতুন গতিতে ফিরে এসেছে।
    নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, হাতিয়া, বেগমগঞ্জ, সোনাইমুড়ী ও চাটখিল জুড়ে একযোগে চলছে “নোয়াখালী বিভাগ চাই” কর্মসূচি।

    ঢাকা প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে মানববন্ধন, সাংবাদিক সম্মেলন ও গণস্বাক্ষর সংগ্রহ কর্মসূচি।
    নতুন প্রজন্মের তরুণ নেতৃত্ব এখন আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি।

    তাদের মতে,
    ভৌগোলিক অবস্থান, জনসংখ্যা, শিক্ষার হার ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার দিক থেকে নোয়াখালী পূর্ণাঙ্গ বিভাগ হওয়ার যোগ্যতা রাখে।

    মানবাধিকার কর্মী শাহানাজ রজব বলেন—
    আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলে তিনটি চর ও একটি বৃহৎ দ্বীপ হাতিয়া রয়েছে। যদি নোয়াখালী বিভাগ ঘোষণা করা হয় এবং হাতিয়াকে নতুন জেলা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তাহলে এখানকার মানুষের দীর্ঘদিনের অবহেলা কিছুটা লাঘব হবে।

    তিনি আরও বলেন,
    হাতিয়ায় দুর্ঘটনা বা দুর্যোগ হলে চিকিৎসা নিতে নোয়াখালী বা ঢাকায় পৌঁছানো কঠিন। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ হলে চিকিৎসা, শিক্ষা ও ত্রাণসেবা সহজলভ্য হবে। এই কারণেই নোয়াখালী বিভাগ গঠন অত্যাবশ্যক।

    তার মতে,
    কুমিল্লা ইতোমধ্যেই উন্নত জেলা। নতুন বিভাগ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু নোয়াখালী ও হাতিয়া উপকূলীয় অঞ্চল হিসেবে নতুন প্রশাসনিক কাঠামো পেলে দেশের অর্থনীতি ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।

    নোয়াখালী বর্তমানে প্রশাসনিকভাবে বৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল।
    এর আওতাধীন উপজেলাগুলো—বেগমগঞ্জ, সোনাইমুড়ী, সেনবাগ, চাটখিল, সুবর্ণচর, হাতিয়া, কবিরহাট—সব মিলিয়ে জনসংখ্যা ৩০ লক্ষাধিক।
    এই পরিসর থেকে বোঝা যায়, নোয়াখালী একটি অতিরিক্ত প্রশাসনিক চাপযুক্ত জেলা, যা একটি বিভাগীয় কাঠামোর দাবি রাখে।

    অর্থনৈতিকভাবে, চিংড়ি শিল্প, কৃষি, মাছ ধরা, ও হালকা শিল্পের মাধ্যমে নোয়াখালী দেশের জিডিপিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
    তবে প্রশাসনিক কেন্দ্রের অভাবে উন্নয়নের গতির অনেকটা স্থবির হয়ে আছে।

    নোয়াখালী বিভাগ হলে—
    প্রশাসনিক কার্যক্রম সহজ হবে
    উপকূলীয় দুর্যোগ মোকাবেলায় কেন্দ্রীয় সহায়তা বৃদ্ধি পাবে
    শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়বে
    পর্যটন ও বাণিজ্য সম্ভাবনা (বিশেষ করে হাতিয়া ও নিঝুমদ্বীপে) বাস্তবায়ন সহজ হবে।

    বিশেষজ্ঞদের মতে,
    যেভাবে ময়মনসিংহকে বিভাগ করা হয়েছে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও জনসংখ্যা বিবেচনায়, ঠিক তেমনি নোয়াখালীরও বিভাগ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া উচিত।

    নোয়াখালী বিভাগের ইতিহাস আসলে একটি আত্মপরিচয়ের সংগ্রাম।
    ১৯১০ সালে যে চেতনার সূচনা হয়েছিল, সেটি এক শতাব্দী পার হয়ে আজও জীবন্ত।
    এই আন্দোলন কেবল প্রশাসনিক সুবিধার দাবি নয়
    এটি একটি অঞ্চল, একদল মানুষের অস্তিত্ব, ইতিহাস ও গর্বের লড়াই।

    “নয়া খাল” থেকে জন্ম নেওয়া এই জেলার মানুষ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অধ্যবসায়, শিক্ষা ও সংস্কৃতির আলো ছড়িয়ে এসেছে।
    আজ তাদের একটাই স্বপ্ন—
    নোয়াখালী বিভাগ বাস্তবায়িত হোক—যাতে উপকূলের মানুষ উন্নয়নের মূল স্রোতে সম্পৃক্ত হতে পারে।

    উপরের নিউজটি মাঠ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে করা এ বিষয়ে কোন দ্বিমত থাকলে প্রমাণসহ dailyswadhinshomoy@gmail.com এ ইমেইল করে আমাদেরকে জানান অথবা আমাদের +88 01407028129 নাম্বারে হোয়াটসঅ্যাপ করুন।
    আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
    এই বিভাগের আরও খবর
     
    Jugantor Logo
    ফজর ৫:০৫
    জোহর ১১:৪৬
    আসর ৪:০৮
    মাগরিব ৫:১১
    ইশা ৬:২৬
    সূর্যাস্ত: ৫:১১ সূর্যোদয় : ৬:২১

    আর্কাইভ

    October 2025
    S M T W T F S
     1234
    567891011
    12131415161718
    19202122232425
    262728293031