দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন যে বিপুল পরিমাণ মাদক দেশে প্রবেশ করছে, তা এখন কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উদ্বেগের বিষয় নয়—এটি পরিণত হয়েছে এক পূর্ণমাত্রিক জাতীয় সংকটে। কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার থেকে অবাধে আসছে ইয়াবা, ক্রিস্টাল মেথ (আইস) ও অন্যান্য প্রাণঘাতী মাদক।
মাত্র এক দিনে—২১ জুলাই—দুই লাখ ইয়াবাসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তারের ঘটনা এ প্রবাহের ভয়াবহতা স্পষ্ট করে দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মিয়ানমারে চলমান সংঘাতের সুযোগে সক্রিয় আন্তর্জাতিক মাদক চক্র বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। আরাকান রাজ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহী আরাকান আর্মির সংঘর্ষে সীমান্ত অঞ্চল কার্যত নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে। এই শূন্যতার সুযোগেই গড়ে উঠেছে সুসংগঠিত মাদক রুট, যা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মাদক সরবরাহ করছে।
সরকারি তথ্য বলছে, চলতি মাসের প্রথম ২০ দিনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রায় ২২ লাখ ইয়াবা জব্দ করেছে এবং গ্রেপ্তার করেছে ৩০ জনের বেশি চক্রসদস্যকে। নাফ নদীর শাহপরীর দ্বীপ, সাবরাং, টেকনাফ সদর, বাহারছড়া, ইনানী, হিমছড়ি, ঘুমধুম, পালংখালী, উনচিপ্রাংসহ অন্তত ৩০টি সীমান্ত পয়েন্ট এখন মাদকের অনুপ্রবেশের সক্রিয় রুটে পরিণত হয়েছে। মাদক কেবল স্থলপথেই নয়, নৌপথ ও আকাশপথ দিয়েও প্রবেশ করছে—যার প্রমাণ ঢাকার রেলস্টেশন ও বিমানবন্দরে একের পর এক চালান জব্দের ঘটনা।
বিজিবি, র্যাব ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের নিয়মিত অভিযান প্রশংসনীয় হলেও, বাস্তবতা হলো—এটি প্রবাহ রোধে যথেষ্ট নয়। এই সমস্যা শুধু আইনশৃঙ্খলার নয়; এটি সামাজিক অবক্ষয়, তরুণ সমাজের ধ্বংস এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি।
পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সম্পৃক্ততা। সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করা কিছু রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ এখন মাদক পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে—যা শুধু মাদক নয়, বরং মানব পাচার, অস্ত্র বিস্তার এবং সামগ্রিক নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
বাংলাদেশ আজ এক অদৃশ্য আগ্রাসনের মুখে দাঁড়িয়ে আছে—যেখানে গুলির শব্দ নেই, কিন্তু প্রতিদিন ছড়িয়ে পড়ছে এক নীরব বিষক্রিয়া। মাদকের এই নীরব আগ্রাসন কেড়ে নিচ্ছে সম্ভাবনাময় যুবসমাজকে, ধ্বংস করছে পরিবার ও সমাজ, আর শেষ পর্যন্ত আঘাত হানছে রাষ্ট্রের অস্তিত্বে। তাই মাদকবিরোধী লড়াই আর কেবল স্লোগানে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না—এটি হওয়া উচিত জাতীয় অগ্রাধিকারের শীর্ষে।

